পুরসভার আশ্রয় শিবিরে রাসের যাত্রীরা। — ফাইল চিত্র
জনা পঁয়ত্রিশের দলটা হইহই করতে করতে যখন গঙ্গার ধারে কালী মন্দির চত্বরে হাজির হল, তখনও ভাল করে রোদ ওঠেনি। নবদ্বীপের পুব দিকে গঙ্গার ঘাট লাগোয়া শ্রীবাসঅঙ্গন চড়ার কালীমন্দির চত্বরে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রোদন গিরি। পলিথিন বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়েন জনা পঁচিশের হা ক্লান্ত দলটি। এ বার নিশ্চিন্তে ব্যাগ থেকে বের হয় স্টিলের কানা উঁচু থালাটা। তাতে ভর্তি মুড়ি আর একদলা তরকারি। মুড়ির মাঝখানে গর্ত করে তাতে একটু জল ঢেলে তরকারি দিয়ে মেখে দলা করে প্রাতঃরাশের তোফা ব্যবস্থা করে ফেলেন।
এ ভাবেই প্রতি বছর রাসের মরশুমে মেদিনীপুরের কৃষ্ণনগর, খিড়পাই, বাদনগঞ্জের মতো এলাকা থেকে সদলবলে ওঁরা আসেন। নবদ্বীপের গঙ্গায় স্নান করে ধামেশ্বর মহাপ্রভু দর্শন তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য। রাসটা উপরি। জানান দলের প্রধান রোদন গিরি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ইচ্ছা করেই রাসের সময়টা বেছে নিই। একই সঙ্গে মায়াপুর হয়ে সোজা শান্তিপুরের ভাঙ্গারাস দেখে তবে বাড়ি ফেরা।’’ পেশায় ক্ষেতমজুর রোদন গিরির মতো অনেকেই ফি বছর মুর্শিদাবাদের লালগোলা, বাঁকুড়ার অম্বিকানগর, বৈতাল অথবা পুরুলিয়ার হুড়া, বামুনডিহি কিংবা পূর্ব মেদিনীপুরের দরিয়াপুর বা পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দল বেঁধে রাস দেখতে আসেন। ওঁরা রাসের ‘যাত্রী’।
পেশায় দিন মজুর কিংবা প্রান্তিক চাষি ওই মানুষগুলো একে অন্যের আঁচলে বা গামছায় গিঁট বেঁধে হাজির হয়ে যান কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী, নবদ্বীপের রাস, শান্তিপুরের ভাঙ্গারাস বা কাটোয়ার কার্ত্তিক লড়াইয়ের প্রাঙ্গণে। দারিদ্রসীমার কানা ছুঁয়ে কোনও রকমে বেঁচে থাকা এই সব মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেন বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় উৎসবের অন্যতম নিয়ামক দর্শক। তাঁদের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করার কোনও উপায় থাকে না উদ্যোক্তা থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী কারোরই। বরং তাঁদের আসা যাওয়ার নিরিখে মাপা হয় উৎসব কেমন হল। এ বারের রাসে বা জগদ্ধাত্রী পুজোয় কেমন ‘লোক’ হয়েছিল বলতে বোঝানো হয় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর বা মুর্শিদাবাদ থেকে ‘ওঁরা’ কত সংখ্যায় এসেছিলেন।
কিন্তু রাস যত আধুনিক চমকদার হচ্ছে ততই উৎসবের আঙিনা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন ওঁরা। ওঁদের অনুপস্থিতিতে বদলে যাচ্ছে উৎসবের চরিত্র। এখন রাসের দিনে নবদ্বীপ ধাম কিংবা বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টে উপচে পড়া যে ভিড়টা ট্রেন থেকে নামে, তাঁদের জন্য আগে থেকে ‘বুক’ করা থাকে শহরের হোটেল ঘর কিংবা মঠ-মন্দিরের ঝাঁ চকচকে অতিথিশালা। এ পারে জায়গা না হলে, কুছ পরোয়া নেই। আছে ও পারে মায়াপুরে ইস্কনের বিলাসবহুল ব্যবস্থা। প্ল্যাটফর্মের বাইরে অপেক্ষা করে থাকে মঠের গাড়ি, নিদেন পক্ষে টোটো। মাঠের মাঝে পুরসভার নিখরচার যাত্রী শিবিরে কিংবা পথের পাশে গৃহস্তের বারান্দায় গামছা বিছিয়ে রাত কাটিয়ে, পায়ে হেঁটে রাস দেখার কথা ভাবতেই পারেন না তাঁরা।
আর ভাববেনই বা কেন? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে উৎসবের চেহারা। সামঞ্জস্য রেখে পালটে যাচ্ছে দর্শনার্থীদের চরিত্র। এই সময়ের রাসের যাত্রীরা রীতিমতো খোঁজখবর নিয়ে পরিকল্পনা করে আসেন খোলা মাঠের বদলে ইস্কনে থাকেন। বলছিলেন রাসের এক প্রবীণ উদ্যোক্তা মলয় কুণ্ডু। একই সুরে বেঙ্গল হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিত সরকার বলেন, “রাস এখন শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়। বরং পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। নবদ্বীপের রাস, মায়াপুরে ইস্কন হয়ে শান্তিপুরের ভাঙ্গারাস দেখে বাড়ি ফেরা কিংবা কাটোয়ার কার্ত্তিক, নবদ্বীপের রাস, শান্তিপুরের ভাঙ্গা রাস। এই ধরনের প্যাকেজে বেড়াতে আসছেন মানুষ। এ জন্য আগে থেকে ঘর বুক করে, রুট বুঝে নিয়ে পরিকল্পনা ছকে নিয়ে তবে আসেন।”
এ কথা সমর্থন করছেন ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্গাপুজোর অনেক আগে থেকে রাসের জন্য ঘর বুক হয়ে যায়।’’ স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রাসের সময় এই ভিড়ের চাপ বেশি দিনের নয়। সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। বিগত কয়েক বছর ধরে সপরিবার রাস দেখতে আসার লোক বাড়ছে।
যার মূল প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ব্যবসাবাণিজ্যের উপর। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাসের কথায়, “এক জন মানুষও যদি অতিরিক্ত আসেন তা হলেও স্থানীয় বাজারের লাভ। এখন হাজার হাজার পর্যটক আসছেন, তাঁরা রাত্রিবাস করছেন, ফেরার পথে কিছু না কিছু কেনাকাটা করছেন, সবেতেই তো ব্যবসায়ীদের লাভ।” তাঁর কথায়, ‘‘রাস উৎসবে দর্শনার্থীর চরিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। যা আদতে নবদ্বীপের পর্যটন নির্ভর অর্থনীতিকেই চাঙ্গা করছে। টোটো চালক থেকে হোটেল মালিক, প্রত্যেকেই রাস থেকে ক্রমশ বেশি করে লাভের মুখ দেখছেন।
মাথাপিছু শ’দুয়েক টাকা আর খোরাকি বাবদ হয়ত জনপিছু দশ কেজি চাল কিংবা পাঁচ কেজি ডাল। এক জায়গার জড়ো করে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া। যেখানে যেমন মেলে বাস, নৌকা-ট্রেকারে চড়ে জায়গা মতো পৌঁছে যাওয়া। আর যেখানে মেলা বা উৎসব সেখানে পুরোটাই হেঁটে মেরে দেওয়া। থাকার জন্য ধর্মশালা বা প্রশাসনের করে দেওয়া যাত্রীশিবির। দিনের বেলা সবরকম সব্জি দিয়ে চালে-ডালে। আর রাতে সঙ্গে করে আনা মুড়ি-চিঁড়ে-ছাতু। শাল বা কলাপাতায় খাওয়া। এমন যাত্রীদের দিয়ে উৎসবে ভিড় বাড়লেও ব্যবসাবাণিজ্যের তেমন উপকার হতো না, এ কথা বলাই বাহুল্য।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমশ ভাল হওয়ায় আরও বেশি বেশি মানুষ উৎসবে সামিল হচ্ছেন। কিন্তু আঁচলে গিঁট মেরে, খালি পায়ে লম্বা লাইন করে চলা গ্রামীণ মানুষেরা ক্রমশ কমে আসছেন।
উৎসবের রাতে শূন্য থাকছে রাস্তার ধারের লম্বা বারান্দা, অস্থায়ী যাত্রী শিবির কিংবা হেমন্তের শিশিরমাখা নদীর চর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy