এই শহর জানে ‘তাঁর’ প্রথম সব কিছু।
আর জানবে নাই বা কেন? মঠ-মন্দিরের শহর নবদ্বীপে বহু ব্যাপারে তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক। মা-ঠাকুমার হাতের তালের বড়া যে জন্মাষ্টমির সন্ধ্যায় ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া যায় কিংবা বৈষ্ণব মঠ-মন্দিরে দেবতার ভোগের মালপোয়া যে বিপণনযোগ্য হতে পারে এ কথা তাঁর আগে কে ভেবেছিলে প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র নবদ্বীপে? নয় নয় করে বিশ বছর আগে শীতের রাতে গরমাগরম খিচুড়ি প্লেট হিসাবে কিনে খেতে এ শহরের মানুষকে তো তিনিই শিখিয়েছেন। তাঁর হাতের প্রসাদ গুণে এবং পরিবেশনার অভিনবত্বে পৌষপার্বণে পিঠে থেকে পাটিসাপটা, পুলি থেকে সরুচুকলি, দশমীর নারকেল নাড়ুর মতো ঘরোয়া খাবার কিনতে তাঁর দোকানে ভিড় জমানো ক্রেতারা নিজেরাই অবাক হয়ে ভেবেছেন, ‘এমনটাও হয় নাকি?’
তিনি শিবপদ সেন। শহরের আবালবৃদ্ধবণিতা অবশ্য তাঁকে শিবু সেন নামেই চেনেন। বৃহস্পতিবার বৃষ্টিভেজা রাতে ৮৯ বছর বয়সে নিঃশব্দে চলে গেলেন জেলার ব্যতিক্রমী এই মিষ্টান্ন শিল্পী। কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিলেন একদা সারা ভারত চষে বেড়ানো শিবুবাবু।
শুধু মিষ্টি বা খাবারে নয়, যে কোনও বিষয়েই তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল অসাধারণ। আজ থেকে তিন দশকেরও আগে অনুষ্ঠান আয়োজনের স্থানাভাবে গৃহস্থের বিড়ম্বনা ধরা পড়ে ছিল তাঁর চোখে। আর সেই সমস্যা সমাধানে বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা শ্রাদ্ধের মতো অনুষ্ঠানের জন্য বাড়িভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা এ শহরে তিনিই প্রথম শুরু করেন। তাঁর ‘যোগ-বিয়োগ’ নবদ্বীপের প্রথম অনুষ্ঠান বাড়ি। তারপর শহরে অসংখ্য অনুষ্ঠান বাড়ি হয়েছে।
মা যখন মারা যান তখন শিবু সেনের বয়স মাত্র আট মাস। মাসির কাছে মানুষ। ১৯১৫ সাল নাগাদ নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় বাবা মহিতোষ সেন একটি মিষ্টির দোকান করেন। ছোট্ট একটা খড়ের চালার দোকানে মিষ্টি, নোনতা খাবার কেনাবেচা করতেন মহিতোষবাবু। নবদ্বীপে রসিক মহলে মহিতোষবাবুর কচুরির দারুন কদরও ছিল। শিবুবাবুর ছেলে যদু সেন বলেন, “নবদ্বীপের পুরনো লোকেদের কাছে শুনেছি, ঠাকুর্দা একবেলা দোকান করতেন। তারপর বাবাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। পরবর্তী কালে বাবার বেড়ানোর নেশা সম্ভবত ওখান থেকেই পাওয়া। ভারতের এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে বাবা যাননি। তাছাড়া বাবা সব রকমের কাজ জানতেন। একার হাতে সব গড়ে তুলেছিলেন। বছর তিন-চার আগেও বাবা নিয়মিত দোকানে যাতায়াত করতেন।” তবে বছর কয়েক আগে স্ত্রী বিয়োগের পর থেকেই কিছুটা ভেঙে পড়েন তিনি।
মহিতোষবাবুর অকাল মৃত্যুর পরে সেই দোকান পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে শিবুবাবুর পরিশ্রম, নিয়মানুবর্তিতা আর দক্ষতার ত্রহ্যস্পর্শে এক সময়ে এলাকার সেরা মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। তিনি নিজেও কারিগর থেকে মিষ্টান্ন শিল্পী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি মিষ্টি মহল, খাবার মহল, অন্নপূর্ণা হোটেল, সেন রেস্তোরাঁ, সেন সাম্রাজ্যের পরিসর বেড়েই চলে। নিত্য নতুন মিষ্টির পদ, খাবারের গুণমানের সঙ্গে আপস না করা এবং পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কঠোর শিবুবাবু দামের ব্যাপারেও অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। চড়া দাম এবং কড়া মেজাজ এই দুইয়ে মিলে রাশভারি শিবুবাবু নিজেই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।
এই বিষয়ে নবদ্বীপের বাসিন্দা, রাজ্য সরকারের আদিবাসী এবং লোক সংস্কৃতি কেন্দ্রের পদস্থ কর্তা গোরাচাঁদ চৌধুরি বলেন, “তাঁর মিষ্টি এবং মেজাজ দুটোই ছিল দুটোই ছিল স্বতন্ত্র। আসলে নিজের হাতে তৈরি খাবারের গুণমান নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি জানতেন যে, ভাল জিনিস খেতে গেলে তাঁর কাছে আসতেই হবে। লোকে যেতেনও।’’ একই কথা বলেন এলাকার বাসিন্দা এবং নামী ট্যাক্স কনসালটেন্ট সৌমিত্র ঘোষ। তাঁর মতে, অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষটি সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিলেন।
পাহাড় তাঁকে বেশি টানত। হিমালয়ের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বার গিয়েছেন। তবে সমুদ্র, জঙ্গল, মরুভূমি কিছুই বাদ দেননি। তাঁর ভ্রমণসঙ্গীরাও ছিলেন অন্য রকমের মানুষ। তাদের মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের নামী অধ্যাপক থেকে পাহাড়ে চড়া ডাকাবুকো যুবক সকলেই ছিলেন।
তাঁর একদা সঙ্গী বিশ্বনাথ সেন বলেন, “দলে যাদবপুরের অধ্যাপক অসিত সরকার কবে কোথায় কী ভাবে যাওয়া হবে সে সব ঠিক করতেন। খাবারের দায়িত্বে শিবুদা। আমার কাজ ছিল ঘরের বিষয়ে দেখভাল করা।” নবদ্বীপ পুরসভার স্বাস্থ্য আধিকারিক সুব্রত পাল বলেন, “প্রতি বছর একদল মানুষ রান্নাবান্নার আয়োজন-সহ বেড়াতে যাচ্ছেন, নবদ্বীপে প্রথম চালু করেন শিবু সেনই।”
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “প্রবীণ এই মানুষটির সঙ্গে নবদ্বীপের ইতিহাসের একটি বর্ণময় অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। সবথেকে বড় কথা এই শহর সম্পর্কে বহু কিছু জানতেন তিনি। চোখের সামনে সাত সাতটি দশক ধরে নবদ্বীপের ভাঙাগড়া দেখেছেন। স্মৃতি থেকে অনর্গল সে কথা বলতে পারতেন। স্থানীয় ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সে সব ছিল অমূল্য সম্পদ। শহর নবদ্বীপের অনেক অজানা কাহিনী হারিয়ে গেল ওঁর সঙ্গেই।”
পনেরো বছর বয়স থেকে একটানা সাতচল্লিশ বছর শিবু সেনের দোকানের মুখ্য কারিগর ছিলেন শ্যাম হালদার। ছেলে আমেরিকাবাসী সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বছর চারেক ধরে তিনি আর কাজ করেন না। কিন্তু এ দিন না এসে পারেননি। বলছিলেন, “পনেরো বছর বয়সে কাজ শুরু। দাদাই একাধারে আমার বন্ধু, অভিভাবক সব ছিলেন। সাতচল্লিশ বছর তো খুব কম সময় নয়। সব কাজ আগে থেকে আলোচনা করে সময় এবং পরিকল্পনা মাফিক সারতেন দাদা।” বেড়াতে যাওয়ার সময় ‘শ্যামকে’ দায়িত্ব বুঝিয়ে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।
শুক্রবার কাকভোরে অঝোর বৃষ্টিতে ঘুমন্ত নবদ্বীপের রাস্তা দিয়ে শেষ বারের মতো চলেছেন শিবু সেন। শবযাত্রার একটু পিছনে একা হাঁটতে হাঁটতে শ্যাম হালদার বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘‘দাদা এ বার কোনও আগাম আলোচনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়লেন। আমাকেও বললেন না। এটা কি ঠিক হল?’’