Advertisement
০৫ মে ২০২৪
পাচারের পাঁচকাহন-৩

পাচারেও ভরসা ‘পুলিশ’

পাচার নিষিদ্ধ। ওঁরা জানেন। কিন্তু মানতে চান না। উল্টে দাবি করেন, এ তো ব্যবসা। সেই ‘ব্যবসা’য় লাভ আছে। জীবনের ঝুঁকি আছে আরও বেশি। তবুও সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হয়নি। বরং বদলেছে তার কৌশল। বদলেছে পাচার সামগ্রী। খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।বহরমপুর-করিমপুর রাজ্য সড়ক দিয়ে সাঁ সাঁ ছুটছিল ধূসর রঙের ছোট গাড়িটি। সামনের কাচের বাঁ দিকে সাদা কাগজের উপরে লাল কালিতে লেখা ‘PRESS’। সীমান্ত ঘেঁষা জনপদে কী এমন বড় ঘটনা ঘটল যে প্রেসের গাড়িকে ছুটে আসতে হল!

অঙ্কন: মণীশ মৈত্র

অঙ্কন: মণীশ মৈত্র

সুজাউদ্দিন ও কল্লোল প্রামাণিক
ডোমকল ও করিমপুর শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬ ০২:৫৭
Share: Save:

বহরমপুর-করিমপুর রাজ্য সড়ক দিয়ে সাঁ সাঁ ছুটছিল ধূসর রঙের ছোট গাড়িটি। সামনের কাচের বাঁ দিকে সাদা কাগজের উপরে লাল কালিতে লেখা ‘PRESS’। সীমান্ত ঘেঁষা জনপদে কী এমন বড় ঘটনা ঘটল যে প্রেসের গাড়িকে ছুটে আসতে হল!

ভুল ভাঙল করিমপুর জামতলা এলাকায়। গাড়িটির সঙ্গে এক সাইকেল আরোহীর ধাক্কা লাগতেই জানা গেল অন্য কোথাও নয়, বড় খবর রয়েছে গাড়ির ভিতরেই। আচমকা ওই ঘটনায় গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় ছিটকে পড়েছে বড় একটি প্যাকেট। প্যাকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে ফেনসিডিলের (কাশির সিরাপ) বোতল। বেশ কয়েকটি আবার রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এলাকার লোকজন ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গিয়েছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও বিএসএফ এসে আটক করে গাড়ি ও বেশ কয়েক হাজার ফেনসিডিল। পাচার রুখতে বিএসএফ ও পুলিশ যত তৎপর হয়েছে, পাল্লা দিয়ে কৌশল বদলেছে পাচারকারীরাও। একটা সময় সার দিয়ে চাল, চিনি কিংবা গরু বোঝাই ট্রাক যেত সীমান্তে। তারপর সময় বদলে গেল। কাঁটাতার বসায় গরু পাচারে কিছুটা লাগাম পড়লেও গাঁজা কিংবা কাশির সিরাপ পাচার কিন্তু বন্ধ হল না। কিন্তু দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত ওই পাচার সামগ্রী নিয়ে যাওয়া হবে কী করে? বাসে নিয়ে যাওয়ার নান ঝক্কি আছে। আগাম খবর পেয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তল্লাশি চলছে অন্য গাড়িতেও। তাহলে উপায়? ডোমকল এলাকার এক পাচারকারীর কথায়, ‘‘মুশকিল আসান করে দিল ‘প্রেস’, ‘পুলিশ’ কিংবা ‘অ্যাম্বুল্যান্স’ লেখা গাড়ি। কখনও কখনও দুধসাদা স্করপিও আমরা ব্যবহার করি।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘তবে এ ভাবেও সবসময় যে শেষরক্ষা হচ্ছে তা নয়। কিন্তু এই ঝুঁকিটুকু না নিলেও তো কারবার লাটে উঠে যাবে!’’

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, সীমান্ত এলাকায় মাঝে কিছুদিন ‘প্রেস’ ও ‘পুলিশ’ লেখা গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছিল পুলিশ ও বিএসএফের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। কারণ গাড়ির উপরে ওই স্টিকার থাকলে সচরাচর কেউ সন্দেহ করে না। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছিল পাচারকারীরা। তবে এখনও অবশ্য স্করপিও ব্যবহার করা হচ্ছে। স্করপিও কেন?

ওই পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘ব্লক থেকে শুরু করে জেলার অধিকাংশ নেতা এখন স্করপিও গাড়ি পছন্দ করছেন। সেগুলোতে নেতারা যাচ্ছেন বলেই তেমন সন্দেহ করা হত না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে স্করপিওতে সবসময় নেতা নয়, ফেনসিডিলও যায়।’’ মাসকয়েক আগে তার প্রমাণও মিলেছে। রানিনগরের রামনগরপাড়া দিয়ে কাহারপাড়া সীমান্তের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটছিল একটি স্করপিও। সুনসান রাতে আচমকা সেই গাড়ির পথ আটকায় পুলিশ। দুধ সাদা সেই ‘ভিআইপি’ গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় হাজার শিশি কাশির সিরাপ। পাচারের অভিযোগে ধরা পড়ে দুই যুবক।

সীমান্তের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পাচারের সঙ্গে গাড়ির যোগ বহু পুরনো। ‘এনফিল্ড’ কিংবা ‘রাজদূত’ একসময় সীমান্ত কাঁপাত। ‘ইয়ামাহা আর এক্স হানড্রেড’, কিংবা ‘হিরো হন্ডা সিডি হানড্রেড’ বাইকের আওয়াজ এখনও মনে আছে সীমান্তের। কাহারপাড়া সীমান্তের এক প্রৌঢ় অবশ্য বলছেন, ‘‘বড়লোকরা গাড়ি বদল করে সখে। আর সীমান্তে গাড়ি বদল হয় পুলিশ ও বিএসএফের চোখে ধুলো দিতে। আমরা মাঝেমধ্যে চমকে যাই এই এলাকায় ঘন ঘন পুলিশ ও প্রেস লেখা গাড়ি দেখে। কখনও কখনও অ্যাম্বুল্যান্সও আসে। অ্যাম্বাসাডার দেখলেই ভাবি গাঁয়ে বুঝি কোনও নেতা-মন্ত্রী এল। তবে ভুল ভাঙতেও দেরি হয় না।’’

নদিয়া পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘সবথেকে বড় অসুবিধা হচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে। আমরাও জানি পাচারের জন্য এখন অ্যাম্বুল্যান্সকেও ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে খবর না থাকলে তল্লাশি চালানোও মুশকিল। সেই ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে।’’ আর নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলছেন, ‘‘জেলায় সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা হাতেগোনা। তবে তার বাইরে অনেক বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সও রয়েছে। পাচারে কোন অ্যাম্বুল্যান্স ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা পুলিশ ও বিএসএফেরও দেখা উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Smuggling border area
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE