প্রচারে: দলের সামনে অপূর্ব পোদ্দার। নিজস্ব চিত্র
অমাইকই বটে। ভিড়ে ঠাসা পোড়ামাতলার মোড়ে জনা সাতেকের একটা জটলা। মাঝে দাঁড়িয়ে বয়সে প্রবীণ দীর্ঘদেহী এক জন মুখের কাছে হাতটা নিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করে চলেছেন। বলার ভঙ্গিতে ঘোষণার ইঙ্গিত।
সন্ধ্যাবেলার পোড়ামাতলায় এমনিতেই কিছু শোনা যায় না। এত শব্দ চারিদিকে। তার মধ্যে খালি গলায় কী বলতে চাইছেন তিনি?
একটু কান পাততেই বোঝা গেল তিনি আসন্ন নবদ্বীপ বইমেলার প্রচার করছেন। ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। হাতের পাকানো মুঠিই যেন তাঁর অদৃশ্য মাইক। তাতে অনর্গল বলে চলেছেন বইমেলার দিনক্ষণ, স্থান-কালের কথা। জানাচ্ছেন কোন কোন প্রকাশনা আসছে, কবে কী অনুষ্ঠান, কারা আসছেন ইত্যাদি তথ্য। আর এ সবের ফাঁকেই বইমেলায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ তাঁর গলায়।
প্রচারের রকম দেখে তাজ্জব লোকজন। মাইক কই? আজকের দিনে এমনটা আবার হয় নাকি? সরকারি বেসরকারি যে কোনও প্রচারই যখন মাইক বিনে গতি নেই, তখন প্রতি সন্ধ্যায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা এ ভাবেই নবদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার করছে বইমেলা কমিটি।
কিন্তু কেন? উত্তরে নবদ্বীপ বইমেলা কমিটির সভাপতি দেবাশিস সরকার বলেন, “এ বারের বইমেলার প্রস্তুতি পর্বের পুরোটাই উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যে চলেছে। এখন মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাই আমরা মাইক ছাড়াই প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” খালি গলায় প্রচারের দায়িত্ব একাই নিজের গলায় তুলে নিয়েছেন মেলা কমিটির সম্পাদক সত্তর ছুঁই ছুঁই অপূর্ব পোদ্দার। দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক কর্মী অপূর্ববাবুর নবদ্বীপে ‘গলাবাজ’ বলে পরিচিতি আছে। কথা বলেন বেশ জোরে। বিভিন্ন মঞ্চে তাঁকে সঞ্চালনা করতেও দেখা যায়। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা কী ছ’টা নাগাদ পোড়ামাতলা থেকে দলবেঁধে বইমেলা কমিটির সভাপতি সম্পাদকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছেন সুশান্ত মিত্র, দেবাশিস রায়, দীপক মিত্র, অজয় ভট্টাচার্য, অরুনপ্রকাশ ভট্টাচার্য, নীরেন পাল, প্রবীর বসুরা। এঁদের বেশির ভাগই ষাট পেরিয়েছেন। দলের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য রাইমোহন ভৌমিকের বয়স আশির কোঠায়।
কিন্তু মাইকে শুনতে অভ্যস্ত কানে কি আদৌ ঢুকছে এই খালি গলার সাদামাটা প্রচার? বইমেলার উদ্যোক্তাদের দাবি, ‘‘খালি গলায় একদল লোক কী বলছে, শুধু এই কৌতূহল থেকেই সাধারণ প্রচারের থেকে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনছেন লোকজন।’’ অপূর্ববাবু যখন কথা বলছেন তখন দলের অন্যরা রাস্তার ধারের বিভিন্ন দোকান ও লোকজনের কাছে বইমেলার টিকিট বিক্রি করছেন। পঁচিশ টাকা দাম। প্রথম দিনের প্রচারেই বিক্রি হয়েছে ৯০টা টিকিট। ১ এপ্রিল থেকে বইমেলা শুরু। তার আগে প্রতিদিন এ ভাবেই চলবে প্রচার।
পোড়ামাতলা রোডের এক ব্যবসায়ী অজয় দাস বলেন, “রাস্তার ধারে দোকান হওয়ায় দিনরাত হাজারো প্রচারের মাইকে কান ঝালাপালা। ভাল করেছে ওরা।”
কিন্তু প্রতি দিন আড়াই-তিন ঘণ্টা গলাবাজি করে তো গলার দফা রফা হয়ে যাচ্ছে? কিঞ্চিত গর্বের সুরেই অপূর্ববাবু বললেন, “আমার গলার জোরের কথা পরিবার থেকে প্রতিবেশি সক্কলে জানে। জোরে কথা বলাটা তো আমার অভ্যাস। প্রচারের শেষে একটু গরম চায়ে গলা ভিজিয়ে নিলেই হল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy