Advertisement
E-Paper

দুর্বলদের জন্য আলাদা ক্লাস স্কুলে

‘অ-এ আজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে...’, ‘পাঁচ দু’গুণে দশ, পাঁচ তিনে পনের...।’ প্রথম শ্রেণির ক্লাসঘর নয়, ওরা পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া। হলে কী হবে, মামুলি যোগ-বিয়োগটুকুও জানে না, গুণ-ভাগ দূরের কথা। এবিসিডি কিংবা অ-আ-ক-খ, বর্ণমালার সঙ্গেও পরিচয় ঘটেনি। প্রাথমিক স্কুলে চার বছর কাটিয়েও অনেক পড়ুয়ার এমনই দশা।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৭
লালগোলার লস্করপুর হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ানো হচ্ছে বর্ণপরিচয়। ছবিটি তুলেছে গৌতম প্রামাণিক।

লালগোলার লস্করপুর হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ানো হচ্ছে বর্ণপরিচয়। ছবিটি তুলেছে গৌতম প্রামাণিক।

‘অ-এ আজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে...’, ‘পাঁচ দু’গুণে দশ, পাঁচ তিনে পনের...।’

প্রথম শ্রেণির ক্লাসঘর নয়, ওরা পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া। হলে কী হবে, মামুলি যোগ-বিয়োগটুকুও জানে না, গুণ-ভাগ দূরের কথা। এবিসিডি কিংবা অ-আ-ক-খ, বর্ণমালার সঙ্গেও পরিচয় ঘটেনি। প্রাথমিক স্কুলে চার বছর কাটিয়েও অনেক পড়ুয়ার এমনই দশা।

লস্করপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে প্রতি বছর এমন বেশ কিছু প়ড়ুয়া ভর্তি হয়। এরা অধিকাংশই রাজমিস্ত্রি, বিড়িশ্রমিক পরিবারের সন্তান। তারা পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক বই পড়বে কী করে? অনেক স্কুলেই তা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। শিক্ষকেরা ক্লাসে পাঠ্য বই পড়িয়ে চলেন। যে পড়ুয়ারা শিখতে পারল, তারা শিখে নেয়। যারা পারে না, তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে শেষে ছেড়ে দেয় স্কুল। লস্করপুরের স্কুলটি কিন্তু ব্যতিক্রম। এখানে শিক্ষকরা গোড়াতেই মূল্যায়ন করে নেন ছাত্রদের। সেই অনুসারে তাদের বিভিন্ন সেকশনে ভাগ করে, বিশেষ তালিমের ব্যবস্থা করেন।

ওই স্কুলে এ বছর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ৫৩০ জন। প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির আলম জানান, ওই ছাত্রদের মধ্যে মাত্র ৩৮জন চতুর্থ শ্রেণির বাংলা ও ইংরাজি ‘রিডিং’ পড়তে পারে, সাধারণ যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করতে পারে। তাদের এ সেকশনে ভর্তি করা হয়েছে। যারা কেবল বাংলা পড়তে পারে এবং নামতা বলতে পারে, তাদের বি সেকশনে (১১৭জন), যারা কেবল বাংলা পড়তে পারে তাদের সি সেকশনে (১৫৫জন), যাদের কেবল অক্ষরপরিচয় রয়েছে তাদের ডি সেকশনে (১৬৭জন) এবং যাদের অক্ষরপরিচয়ও নেই, তাদের ই সেকশনে (৫৩জন) রাখা হয়েছে।

ছাত্রদের মান অনুসারে বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, সহজপাঠ প্রথম ভাগ, সহজপাঠ দ্বিতীয় ভাগ বণ্টন করা হয়। মাস দুয়েক অন্তর ৬ মাসে মোট ৩ বার মূল্যায়ন করার পর পডুয়াদের উন্নতি অনুসারে উপরের সেকশনে উন্নীত করা হয়। ‘‘এ ভাবে ভাগ করে লেখাপড়া করানোয় বি থেকে ই পর্যন্ত মোট ৪টি সেকশন থেকে মাত্র ২ মাসের মধ্যে ৫০ জনকে এ সেকশনে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে,” জানালেন জাহাঙ্গির আলম।

কেন এই বাড়তি উদ্যোগ? প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির আলম বলেন, “আমাদের শিক্ষকরা বুঝেছেন, পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের সাক্ষর করার বাড়তি দায়িত্বটুকু পালন না করলে পাশফেল না থাকার সুবাদে শিশুরা নিরক্ষর থাকবে। কেবল অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শংসপত্র জুটবে। তার খারাপ প্রভাব পড়বে তাদের নিজেদের জীবনে ও পরবর্তী প্রজন্মের জীবনে।”

লস্করপুর হাইস্কুলের শিক্ষকদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তা থেকে উদ্ভূত ওই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয় গত বছর। ইতিমধ্যে তা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তবে প্রথম বছরের থেকে দ্বিতীয় বছরের সাফল্য বেশি। সহশিক্ষক আশরাফ আলি রাজবী বলেন, “এমএ, এমএসসি পাশ-করা শিক্ষকদের কারও কারও মধ্যে বর্ণপরিচয় ও ধারাপাত পড়ানোর বিষয়ে প্রথম বছর কিছুটা উন্নাসিকতা ছিল। কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখতে পাওয়ায় এ বছর শিক্ষকরা অনেক বেশি আন্তরিক হয়েছেন।”

গোটা রাজ্যের দৃষ্টান্ত হতে পারে যে স্কুলটি, সেই লস্করপুর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল তা বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, লালগোলার এক প্রত্যন্ত এলাকায়। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে মোট সংখ্যা ৩৮। পড়ুয়ার সংখ্যা ২৭৫০। তার মধ্যে শতকরা ৬৮ ভাগই ছাত্রী। অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। শিক্ষকেরাই জানালেন, প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই বহু পরিবার ছেলেদের রাজমিস্ত্রির কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দেয় বাইরে। মেয়েরাই স্কুলে আসে। তাই ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এরা অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া।

প্রাথমিকে এই পড়ুয়ারা পড়তে-লিখতে, অঙ্ক করতে না শেখার সমাধান লস্করপুর স্কুলের শিক্ষকরা করছেন ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, চার বছর স্কুলে থেকে এই শিশুরা এগুলি শিখছে না কেন? ‘‘এলাকার ১৫টি প্রাথমিক স্কুল ও শিশু শিক্ষাকেন্দ্র থেকে লস্করপুর স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তাঁরা সঠিক দায়িত্ব পালন করলে আমরাও শিক্ষার্থীদের ঠিক মতো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা দিতে পারি,’’ বলছেন জাহাঙ্গির। এ কথা জেলা শিক্ষা দফতরের আধিকারিকদের জানিয়েও কোনও ফল হয়নি, দাবি করলেন ওই প্রধান শিক্ষক।

ওই ১৫টিই স্কুলেই নয়, জেলা জুড়েই প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা। এ কথা মেনে নিয়েছেন প্রাথমিক স্কুল সংসদের জেলা সভাপতি দেবাশিস বৈশ্য। দেবাশিসবাবু বলেন, “চার বছর একটি স্কুলে থাকার পরও মাতৃভাষা লিখতে-পড়তে পারে না, সাধারণ যোগ বিয়োগ করতে পারে না, এটা ভাবা যায় না।’’ তিনি জানান, ওই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে তিনি জেলার প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করছেন। সেখানে তাঁদের বলা হচ্ছে, পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের চিহ্নিত করে আলাদা ক্লাস তৈরি করে, তাদের মান বাড়ানোর কাজ করতে।

কিন্তু শিক্ষক যেখানে কম, সেখানে দুর্বল ছাত্রদের কী ভাবে আলাদা করে সময় দেবেন শিক্ষকরা? দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, ইতিমধ্যেই প্রতিটি সার্কেলের মধ্যে যে সব স্কুলে বাড়তি শিক্ষক রয়েছে, সেখানে বাড়তি শিক্ষকদের পাঠানো হচ্ছে সেই সব স্কুলে যেখানে ঘাটতি রয়েছে। সময় বের হবে কী করে? ‘‘শিক্ষকদেরই সময় বার করতে হবে। এটা তো তাঁদেরই নৈতিক দায়িত্ব।’’ অনেক রাজ্যে গরমের ছুটিতে স্কুলে ক্যাম্প করে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের এগিয়ে আনা হচ্ছে। এই জেলায় তা হবে কি? এ বিষয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করার আশ্বাস দিলেন তিনি।

দেবাশিসবাবু জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়ারা যাতে রিডিং পড়তে পারে, সাধারণ যোগবিয়োগ ও গুণভাগ করতে পারে, চারপাশের পরিবেশ সর্ম্পকে ওয়াকিবহাল হতে পারে, তার জন্য একটি পাইলট প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে। জেলার ৪১টি সার্কেলের মধ্যে ১৩টি সার্কেলের ৫০৯টি প্রাথমিক স্কুলকে নির্বাচন করা হয়েছে। এখন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পালা চলছে। ‘‘দেখবেন, ২০১৬ থেকে আর এমন কোনও ছাত্র পাবেন না, যে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেও লিখতে-পড়তে পারছে না,’’ দাবি করলেন প্রাথমিক স্কুল সংসদের জেলা সভাপতি।

Teacher school Lashkarpur jahangir alam student Lalgola anal abedin
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy