Advertisement
০৬ মে ২০২৪

অভাবকে জয় করে সফল স্বপন, প্রিয়া

কারও বাবা বাজারে সব্জি বিক্রি করেন। কারও বাবা আবার বাজারে চুল কাটেন। প্রত্যেকের পরিবারেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তবুও হার মানেনি ওরা। দারিদ্রকে তুড়ি মেরে মাধ্যমিকে ভাল ফল করে নজির গড়ল শ্রীরামপুরের প্রিয়া কুণ্ডু, করিমপুরের স্বপন শীল।

সফল দুই পড়ুয়া প্রিয়া কুণ্ডু (বাঁ দিকে), স্বপন শীল।— নিজস্ব চিত্র।

সফল দুই পড়ুয়া প্রিয়া কুণ্ডু (বাঁ দিকে), স্বপন শীল।— নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৫ ০১:১১
Share: Save:

কারও বাবা বাজারে সব্জি বিক্রি করেন। কারও বাবা আবার বাজারে চুল কাটেন। প্রত্যেকের পরিবারেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তবুও হার মানেনি ওরা। দারিদ্রকে তুড়ি মেরে মাধ্যমিকে ভাল ফল করে নজির গড়ল শ্রীরামপুরের প্রিয়া কুণ্ডু, করিমপুরের স্বপন শীল।

শহর নবদ্বীপ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মধ্য শ্রীরামপুরের কুণ্ডুপাড়ার বাসিন্দা গোপাল কুণ্ডুর বড় মেয়ে প্রিয়া। এ বারের মাধ্যমিকে ৬৫৮ নম্বর পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে সে। নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রিয়া কুণ্ডু নবদ্বীপের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে। মাধ্যমিকে তার প্রাপ্ত নম্বর হল ভৌতবিজ্ঞানে ১০০, জীবনবিজ্ঞানে ৯৯, অংকে ৯৮, ইতিহাসে ৯৩, বাংলায় ৯১ ও ভূগোলে ৯০ ও ইংরাজিতে ৮৭।

প্রিয়ার বাবা গোপালবাবু নবদ্বীপ এবং পূর্বস্থলী থেকে কাঁচা সব্জি কিনে এনে সামান্য লাভে শ্রীরামপুর বাজারে বিক্রি করেন। সকাল থেকে রাত কঠোর পরিশ্রম করেও আয় যা হয় তা দিয়ে চারজনের সংসার টানতে হিমসিম গোপালবাবু। ফলে মেয়ের রেজাল্টে আনন্দিত হলেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। তিনি জানান, “মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায়। আমিও বলেছি যেমন ভাবে পারি পড়াব। কিন্তু সেটা যে কিভাবে তা আমি নিজেও জানি না।” মা রেখা কুণ্ডু তাঁতের সুতো কাটেন। এক বান্ডিল সুতো কাটলে ৩০ টাকা মেলে।রেখাদেবী বলেন “সংসারে যেটুকু সুরাহা হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোয় যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে জন্য আমরা সব কিছু করতে পারি।” পড়ার জন্য মেয়েকে কোনদিন কিছু বলতে হয় নি। বরং সারাদিন পড়াশুনোর বহর দেখে মাঝে মাঝে মায়েরই চিন্তা হত “মেয়েটার শরীর না খারাপ হয়।” তবে প্রিয়া জানিয়েছে, ওই ভাবে না পড়লে টেস্টের ৫৮৫ নম্বর মাধ্যমিকে ৬৫৮ হত না।

মধ্য শ্রীরামপুরের ঠিক মোড়ের মাথায় একটি মাত্র ঘরে বাবা মা আর ভাইয়ের সঙ্গে থাকে প্রিয়া। বাবার কাঁচাসব্জি থেকে মায়ের সুতো কাটার সরঞ্জাম, তার মধ্যেই রাতে ঘুমানো - সব কিছু ওই একটি ঘরেই। প্রিয়ার স্কুল নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ের ৮৭ বছরের ইতিহাসে মাধ্যমিকে এত ভালো ফল আগে কখনও হয় নি। এ বার মাধ্যমিকে স্কুলের আরও এক ছাত্রী এবং প্রিয়ার সহপাঠী অনীশা পাল ৬৭৬ নম্বর পেয়ে রাজ্যের মধ্যে অষ্টম হয়েছে। অনীষা এবং প্রিয়া - দুই ছাত্রীর রেজাল্টে নবদ্বীপে মাধ্যমিকের প্রথম দুটি স্থান এবার নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ের দখলে। প্রধান শিক্ষিকা শ্রুতি লাহিড়ী বলেন, ‘‘প্রিয়া খুবই ভালো ছাত্রী। স্কুল ওর পাশে আছে। প্রিয়া উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে স্কুলেই ভর্তি হবে।’’

উচ্চ মাধ্যমিকের পর প্রিয়া ডাক্তারি পড়তে চায়। তার জন্য জয়েন্টের প্রস্তুতি এখনই না হলেও শুরু করতে হবে। কিন্তু মেয়েকে ভরসা দিলেও কী ভাবে হবে বুঝতে পারছেন না গোপালবাবু এবং রেখাদেবী। খড়কুটোর মতো যাকে পাচ্ছেন তাঁকেই জানাচ্ছেন পরিস্থিতির কথা। কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছেন কি ? উত্তরে জানালেন, “রেজাল্ট বের হওয়ার পরেই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক বাড়িতে এসেছিলেন। বলেছেন প্রিয়ার লেখাপড়ার সব রকম সাহায্য করবেন।” শ্রীরামপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপবাবু বলেন, “প্রিয়া শ্রীরামপুরের গর্ব। আমাদের এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ নির্দেশ দিয়েছেন ওর লেখাপড়ার ব্যাপারে যাবতীয় সহায়তা করতে। ওর ব্যাপারে কোনও চিন্তা করতে হবে না।”

অন্য দিকে, করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপন এ বছর মাধ্যমিকে ৬৪০ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সে বাংলায় ৮৬, ইংরেজিতে ৮৩, অঙ্কে ৯৯, ভৌতবিজ্ঞানে ৯২, জীবনবিজ্ঞানে ৯৯, ইতিহাসে ৯১ ও ভূগোল ৯০ পেয়েছে। বাবা সুব্রত শীল পেশায় নাপিত। দিন গেলে মেরেকেটে আয় বলতে শ’খানেক টাকা। সেই টাকাতেই কোনও রকমে দিন গুজরান করতে হয় শীল পরিবারকে।

বাবা অসুস্থ থাকলে পেটের টানে স্বপনকে কাজ করতে হয়। না হলে যে অন্ন সংস্থান করাই দায় হয়ে পড়বে। সেই কারণে প্রতিদিন স্কুলে যেতেই পারেনি সে। মা শনেকাদেবী ছাগল-মুরগি পুষে সংসারের অভাব খানিকটা লাঘব করার চেষ্টা করেন। এক কামরার টালির ছাউনি ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে মাস ছ’য়েক আগে। তার আগে স্বপনকে সন্ধ্যা বেলায় পড়াশোনা করতে হত লম্ফের টিমটিমে আলোতেই। বিদ্যুৎ এলেও ঘরে কোনও পাখা নেই। পাছে‌, বিদ্যুত‌ের বিল বেশি আসে। এ ভাবেই দারিদ্রতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে মাধ্যমিকে ভাল করেছে স্বপন। স্বপনের দাদা বাপন ইংরেজি অনার্স নিয়ে করিমপুর পান্নাদেবী কলেজে পড়েন। অভাবের সংসারে দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমসিম খাওয়ার উপক্রম বাবা সুব্রত শীলের। শনেকাদেবীর কথায়, ‘‘দুই ছেলেই পড়াশোনা করছে। পরিবারের আয় যৎসামান্য। তবুও হাল ছেড়ে দিইনি। ছেলেদের সেভাবে টিউশন দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। নিজের দায়িত্বে পড়াশোনা করেই ছেলে ভাল ফল করে‌ছে।’’ কথাগুলি বলার সময়ই চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ছিলেন বছর চল্লিশের ওই মহিলা। তারপর আপন মনেই বলে যান, ‘‘কীভাবে যে ওকে উচ্চ শিক্ষা দেব বুঝতে পারছি না।’’

স্বপনের তিনজন গৃহশিক্ষক ছিলেন। যদিও স্বপনকে তাঁরা পড়িয়েছেন বিনা পয়সায়। স্বপনের কথায়, ‘‘শিক্ষকেরা টাকা নিতেন না। উল্টে বইপত্র দিয়ে ওঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন। এ ছাড়াও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন।’’ স্বপনের ইচ্ছে বড় হয়ে বিমান চালক হওয়া। আকাশে ওড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে অর্থই অন্তরায় বলে মনে হচ্ছে স্বপনের। করিমপুর জগন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বাগত অধিকারী বলেন, “স্কুলের তরফে আমরা ওকে সাধ্যমতো সাহায্য করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE