ক্রেতার আশায়। বহরমপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়েছেন মুর্শিদাবাদের ফল চাষিরা।
প্রায় দু’ দশক আগে রাজ্য সরকারের নিয়োগ করা একটি সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, মুর্শিদাবাদ জেলার আর্থিক পরিকাঠামোর উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করছে আম, কাঁঠাল, লিচুর মতো ফলের প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণের উপরে। অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারই ওই বিষয়ে উদ্যোগী হয়নি। ফলে ফি বছর ফলন যেমনই হোক না কেন, ভুগতে হয় ফল চাষিদের।
চাষিদের আক্ষেপ, এ বার আমের ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু তাঁরা দাম পাচ্ছেন না। আবার কোনও বছর ফলন কম হলেও তাঁরা লাভের মুখ দেখতে পান না। আর এই সুযোগে ফড়েদের পোয়াবারো হলেও আমচাষিদের কোনও বারই কপাল খোলে না। জেলায় প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও এমনটা হত না বলেই মত চাষিদের।
ভাগীরথীর পূর্ব পাড়কে বলা হয় বাগড়ি অঞ্চল, আর পশ্চিম পাড়কে রাঢ়। ভূপ্রকৃতির কারণে রাঢ় অঞ্চলে ধান বেশি হওয়ায় ওই এলাকাকে বলা হয় ভাতঘর। গাঙ্গেয় পলিমাটি বিধৌত ভূপ্রকৃতির কারণে বাগড়ি অঞ্চল আম, কাঁঠাল ও লিচু চাষের উপযুক্ত ও উর্বর অঞ্চল। প্রকৃতির সেই দান কাজে লাগিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে নবাবেরা মুর্শিদাবাদ জেলায় আমবাগিচার উন্নতিতে মন দেন। ফলে এই জেলায় নবাবি আমলে ও এমনকী ব্রিটিশ শাসন কালেও ২৫০ প্রজাতির সুমিষ্ট ও সুস্বাদু আমের বাগান ছিল। পরবর্তীতে আম বাগান কেটে বসত বাড়ির জন্য প্লট করে জমি বিক্রি শুরু হয়। ফলে ঐতিহ্যশালী আমবাগানের অনেক গুলিই আজ অবলুপ্ত। ওই অবলুপ্তি থেকে ঐতিহ্যের বাগান রক্ষা করতে বাম আমলে তৎকালীন ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী সরকারি স্তরে গঠন করেন ‘আমবাগান রক্ষা কমিটি’।
বর্তমানে এই জেলায় আমবাগানের পরিমান ২৩ হাজার হেক্টর। মুর্শিদাবাদ জেলার উদ্যানপালন দফতরের উপ-আধিকর্তা গৌতম রায় বলেন, ‘‘তার মধ্যে সিকিভাগ বাগানের বয়স ৩-৪ বছর। এ কারণে সেই সব বাগানের অতি সামান্য ফলন হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৫ ভাগ বাগানে এ বছর আমের ফলন হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার মেট্রিক টন।’’ ওই বিপুল ফলনের ফলে বিপাকে আমচাষিরা। মুর্শিদাবাদ জেলার বাজরে আমের খুচরো দর কেজি প্রতি ২০-৩০ টাকা হলেও আমচাষির ঘরে জমা পড়ে কেজি প্রতি ১৫-২০ টাকা। লালবাগের আমচাষি হায়াতুন নবি বলেন, ‘‘গত বছর জামাইষষ্ঠীতে ৮০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রি করেছি। এ বারে ষষ্ঠীতে ২০-৩০ টাকার বেশি দাম ওঠেনি। কারণ, গত বছরের থেকে এ বার দ্বিগুণ আম ফলেছে।’’
হায়াতুনের আক্ষেপ, ‘‘আম, কাঁঠাল, লিচু সংরক্ষণের ও প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা থাকলে চাষিকে এ ভাবে অভাবি বিক্রয়ে বাধ্য হতে হয় না। ২-৩ মাস আম সংরক্ষণ করার পর বিক্রি করলে ভাল দাম পাওয়া যেত। আমের আচার, জ্যাম, জেলি, আমসত্ত্ব ও আমচুর-সহ নানান পদ তৈরির প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্প গড়ে উঠলে চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পেতেন।’’ উদ্যানপালন দফতরের সহ-অধিকর্তা শুভদীপ নাথ বলেন, ‘‘আইসবাগ, আজিমগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ ও বলরামপুরের মতো এলাকায় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ছোট ছোট কয়েকটি শিল্প রয়েছে। কিন্তু সেগুলি প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।’’ রাজ্য সরকারের নিয়োগ করা ওই সংস্থার সমীক্ষা মেনে ১২-১৪ বছর আগে রঘুনাথগঞ্জের মঙ্গলজোন এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি প্রস্তাবিত মেগা ফুডপার্কের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরে সেই প্রকল্পটি মঙ্গলজোন থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে তালাই এলাকায় স্থানান্তরিত হয়। প্রায় শতাধিক বিঘা জমি জুড়ে আরও এক বার শিলান্যাস করা হলেও আজও সেই মেগা ফুডপার্ক আলোর মুখ দেখেনি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন রঘুনাথগঞ্জের তালাই এলাকায় আরও একটি মেগা ফুডপার্কের শিলান্যাস করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৮২ বিঘা জমি জুড়ে ১৩০ কোটি টাকার পিপিপি মডেলের ওই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষের পথে। কিন্তু ওই মেগা প্রকল্প আমচাষির কোনও কাজেই লাগবে না। প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোগপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘‘ওই প্রকল্পে থাকছে চালকল, আলু, আপেল ও সব্জি সংরক্ষণের জন্য ৫টি হিমঘর ও ফলের রসের কারখানা। এখানে আম, কাঁঠাল ও লিচু সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা থাকছে না।’’ কেন?
জাকির হোসেন জানান, ২-৩ মাসের জন্য আম লিচু সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রযুক্তির প্রকল্প। ওই প্রযুক্তি রয়েছে নেদারল্যান্ডে। কেবল ওই প্রযুক্তির জন্যই খরচ হবে অন্তত ৫ কোটি টাকা। মোট প্রকল্পে ব্যয় হবে কম করেও ২৫ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যয়ের অন্তত অর্ধেক সরকারি ভর্তুকি না দিলে কোনও উদ্যোগপতি ওই প্রকল্পে আগ্রহী নয়। তাই অনেক বছর ধরে অনেক আলোচনা হলেও আম, লিচু সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে ওঠেনি এ জেলায়।
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন বলেন, ‘‘জেলায় বেশি ফলনের কারণে ৮-১০ টাকা কেজি দরেও আম বিকোচ্ছে। আম চাষিদের বড়ই দুর্দিন। সেই দুর্দশা মেটাতে এ জেলায় প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের প্রকল্প নির্মাণে জরুরি পদক্ষেপ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছেন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ দফতরের মন্ত্রী অরূপ রায়।’’
সেই ‘জরুরি পদক্ষেপ’ কবে নাগাদ কার্যকরী হবে তার অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy