সব্জি হাটের জন্য রাস্তায় যানজট। নাজিরপুরে কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।
মেরেকেটে ফুট আটেক চওড়া রাস্তা। দু’পাশে আষাঢ়ের ভরা নয়ানজুলি। তার পর টানা আবাদি জমি।
আলপথ আর ঘাস মুড়িয়ে পায়ে হাঁটা পথে কাটাকুটি খেলছে দূরের গ্রাম— নিতান্ত আটপৌরে এই ছবিতেই সপ্তাহের আর পাঁচটা দিন চুপ করে থাকে নাজিরপুর।
কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়কের সেই ছোট্ট জনপদটাই জেগে ওঠে সপ্তাহের মাঝে আর অন্তে—বুধ আর রবিবাসরীয় সকালে। করিমপুরের আশপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে যে নিবিঢ় ভিড়টা একেবারে অচেনা করে তোলে নাজিরপুরকে সে’টা সপ্তাহের ওই দু’টো দিনই। করিমপুরের মানুষ তাই ঈষৎ শ্লেষ মিশিয়ে বলেন, ‘‘হেটো নাজিরপুর, হপ্তার ওই দু’টো দিন যেন ব্যস্ত একটা শহর হয়ে ওঠে।’’
নাজিরপুর তো নয় যেন, হাট বসেছে রাস্তা জুড়ে। পাঁচশো মিটার রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে যেতে সময় লাগে কখনও আধ-ঘণ্টা কখনও বা তারও খানিক বেশি।
আর তাই বুধ আর রবি, ও পথ এড়িয়েই চলেন আশপাশের গাঁয়ের মানুষ। এমনকী বাস-ট্রেকারও।
সঙ্গে রয়েছে সাইকেল, মোটরবাইক, লছিমনের ভিড়। হাটের মুখে, সার দিয়ে ওই শীর্ণ রাস্তার দু’পাশেই দাঁড়িয়ে তাকে তারা।
আর তার জেরটা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। অসুস্থ রোগীকে করিমপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে রবিবার সকালে চাকরির পরীক্ষা দিতে ওই পথটুকু পার হতে গিয়ে কেউ খুইয়েছেন স্বজন, কেউ বা চাকরির সেই পরীক্ষায় বসতেই পারেননি। আর হায়াত মণ্ডলের কথায়, “ছেলে নাজিরপুর স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বুধবারটা আর ছেলেকে স্কুলে পাঠাই না। ওই ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যাবে! পড়াশোনার ক্ষতি হলেও নিশ্চিন্তে থাকি বাবা।” আশপাশের স্কুলগুলোতে তাই বুধবার হাজিরা প্রায় তাকে না বললেই চলে।
করিমপুরমুখী ট্রেকারও, সকাল থেকে হাট-ভেঙে পারাপার বন্ধ রেখে থমকে যায় হাটের মুখে, বাসও তাই। করিমপুরের পুরনো বাসিন্দা, শ্রীনিবাস বিশ্বাস বলছেন, ‘‘করিমপুরের মানুষ তাই রবিবার সকালে দূর গাঁয়ের কুটুমদের নিমন্ত্রণ করাও ছেড়ে দিয়েছেন! কোনও ঠিক আছে, কখন পৌঁছবেন তাঁরা!’’
বাস মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, ওই দু’দিন সকালে ও পথ এড়িয়েই চলেন তাঁরা। বেসরকারি বাসের সংখ্যাও তাই ওই দু’দিন চলাচল করে কম।
আবার, এর একটা অন্য দিকও তুলে ধরছেন অনেকে। আশপাশের অন্তত চল্লিশটি গ্রামের চাষিরা তাঁদের সব্জি এ হাটে বিক্রির করেন। টোপলার আলিমুদ্দিন শেখ কিংবা গোপালগঞ্জের সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘ওই দু’টো দিনই তো আমাদের বিকিকিনি। সপ্তাহভর ও দিকেই তো তাকিয়ে থাকি।’’
পেঁপে, বেগুন, পটল কলার ভিড়ে হাটুরেদেরে জন্য অস্থায়ী চায়ের দোকান থেকে চপ-মুড়ি-ফুলুরির তোলা উনুনের পসরা। সস্তার টিপ-ফিতে-চুড়ি-দুল থেকে খেলনা এমনকী জামাকাপড়— হাটের বিকিকিনির মাঝেগ্রামীণ মানুষের নিতান্ত অপরিহার্য এই শৌখিনতাগুলোও উঠে আসে নাজিরপুরের হাটে।
কিন্তু করিমপুরের লাগোয়া রামনগরের হরেশ্বর মণ্ডল মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘হাট খুব জরুরি। তা বলে চলাচলের পরিসরটুকু তো রাখতে হবে। সেটুকু থাকলে আমার বাবাকে ও ভাবে চলে যেতে হত না!’’
হরেশ্বর জানাচ্ছেন, বছর দুয়েক আগে, হাটবারের আগের রাতে বুকে ব্যাথা উঠল বাবার। সকালে অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে হাসপাতালের পথে নাজিরপুর বাস স্যান্ডের কাছেই আটকে গিয়েছিল সেই অ্যাম্বুল্যান্স। ভিড় ভেহে তার নড়তে সময় লেগেছিল পাক্কা চল্লিশ মিনিট। রাস্তাতেই মারা গিয়েছিলেন তাঁরা বাবা। আর টোপলা গ্রামের কুতুবুদ্দিন তো করিমপুরে সরকারি পরীক্ষাতেই বসতে পারেননি সময়ে। রবিবারের হাট আটকে পরীক্ষা হলে তিনি যখন পৌঁছন তখন এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে।
টোপলা গ্রামের মিরাজ্জুদ্দিন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আমাদের মতো এলাকার কয়েক হাজার চাষি এখানে সব্জি নিয়ে ভিড় করে। ফলে সত্যিই রাস্তায় যানজট হয়। ভিতরে বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নিজস্ব জায়গা থাকলেও এখানেই হাট বসে। সমস্যাটা পেকেছে তাই।’’
নাজিরপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বিদুভূষণ মণ্ডল বলেন, “রাজ্য সড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভিতরে আমাদের সমিতির নিজস্ব জমি রয়েছে। সেখানে হাট বসার অনেক বেশি জায়গা থাকলেও কাঁচামাল বোঝাই বড় বড় ট্রাক যাওয়ার উপযোগী রাস্তা নেই। হাটটা তাই কার্যত উঠে এসেছে রাস্তাতেই।’’
তেহট্ট মহকুমাশাসক অর্ণব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “করিমপুর কৃষ্ণনগর রুটে কোন রেল যোগাযোগ নেই। এই রাজ্য সড়কটিই যোগাযোগের একমাত্র উপায়। বিশেষ করে রোগীদের নিয়ে যাওয়ার সময় খুব সমস্যায় পড়তে হয় অনেককেই।’’ তিনি জানান, রাস্তা থেকে ভিতরে হাটে যাওয়ার রাস্তাটা চওড়া করার জন্য নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতি বোর্ডের দফতরে প্রস্তাব গিয়েছে। সে রাস্তা হলেই বুধ-রবিতে হাটের চেহারাটা বদলে যাবে।
নাজিরপুর সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy