বিড়ি বাঁধছেন মেয়েরা। রঘুনাথগঞ্জে বিড়ি মহল্লায়। —ফাইল চিত্র
ধুলিয়ানের হালেমা বেওয়ার বয়স বছর বত্রিশ।
বছর পাঁচেক আগে পেশায় লরি চালক স্বামী দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে চার ছেলে মেয়ের সংসারটা বিড়ির সুতোয় বেঁধে ফেলেছিলেন।
যা মজুরি পেতেন, তা থেকে কিছু টাকা প্রভিডেন্ড ফান্ডে জমানো, এই ছিল নিতান্তই সঞ্চয়। বছর ছয়েকের মধ্যে পি এফ’য়ের সেই টাকা তুলে নেওয়ার পরে মাস ঘুরতেই হালেমা বুঝেছিলেন কী সর্বনাশটা করেছেন। তখন অবশ্য বিড়িক সুতোয় বাঁধা পড়ে গিয়েছেন তিনি।
সুমি বিবির বাড়ি সুতির বাজিতপুরে। সোমত্ত মেয়েটার বিয়ের ঠিক হয়েছিল। তাই টাকার সংস্থান করতে আট বছর ধরে জমানো প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাটাই শেষ পর্যন্ত তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
পেনসনের তালিকা থেকে কাটা পড়েছে সুমি বিবির নামও।
হালেমাকে ‘বুদ্ধি’টা দিয়েছিলেন যিনি, তাঁকে মুনশি বলেই চেনেন বিড়ি মহল্লা। আর সুমি বিবিকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন এক বিড়ি মহাজন।
মুনশি-মহাজনের ‘পরামর্শে’ এ ভাবে অজান্তেই সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন হালেমারা।
গ্রামে গ্রামে হালেমা ও সুমিদের তাই প্রায়ই লাইন পড়ছে জঙ্গিপুরের মঙ্গলজনে জঙ্গিপুরের আঞ্চলিক প্রভিডেন্ড ফান্ড কমিশনারের দফতরের সামনে। সকলেরই আর্জি প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ফেরত চাই।
হালেমার কথায়, “বিড়ি মুনশি বলল জমানো টাকা তুলে নিতে। না হলে টাকা পেনসন স্কিমে পড়ে গেলে জমানো টাকাটাও নাকি আর ফেরত পাব না। সরকার নিয়ে নেবে।’’ তাই গ্রামেরই এক জনকে ধরে জমা পড়া প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা তুলে নিয়েছিলেন হালেমা। আর সং জন্য দাদালকে দশ শতাংশ বখরাও দিতে হয়েছিল তাঁকে। পিএফ অফিসে ধর্মা দিয়ে হালেমা বুঝেছেন, আদতে ওই বখরার লোভেই পিএফ-র টাকা তুলে নেওয়ার ‘সু-পরামর্শ’ দিয়েছিল মুনশি। সুমি বিবি অবশ্য তার পি এফের টাকা তুলতে পাড়ার রমজান ভাইকে সাহায্য করায় ৬০০টাকা দিয়েছে বখসিস বাবদ। তাঁর কথায়, “বিয়েতে শেষ মুহূর্তে ঠেকে গিয়েছিলাম। রমজান ভাইই পিএফ থেকে টাকা তোলার যুক্তিটা দিল। বিয়েটাও ভালয় ভালয় মিটল।” কিন্তু পিএফ তুলে নেওয়ায় আপনার পেনসন পাওয়ার রাস্তাটা যে বন্ধ হয়ে গেল? সুমি বিবির অকপট সাফাই, “আমরা কী আর অত বুঝি বাবু!’’
আর, সেই সুযোগটাই যে কার্যত ‘ফতুর’ করছে তাঁদের জঙ্গিপুর আঞ্চলিক প্রভিডেন্ড ফান্ড দফতরের সহকারি কমিশনার প্রদীপ কুমার চট্টোপাধ্যায়ও তা জানেন। বলছেন, বলছেন, “প্রতারিত ওই বিড়ি স্রমিকেরা প্রায়ই বিড় করেন। খারাপ লাগে। কী রব বলুন!’’
কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক বিড়ি শ্রমিকদের জন্য যে সব সুযোগ সুবিধা বরাদ্দ রেখেছেন তারই অন্যতম সুবিধা ৫৮ বছর বয়সের পর অবসরকালীন পেনসন পাবেন বিড়ি শ্রমিকেরা। শ্রম মন্ত্রকের নির্দেশ অনুসারে বিড়ি শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরির ১২ শতাংশ টাকা জমা পড়বে পিএফ ফান্ডে। সম পরিমাণ টাকা সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের নামে পিএফ খাতে জমা দিতে হবে ।
এই সম্মিলিত অর্থের ৮.৫ শতাংশ জমা পড়ে শ্রমিকের জন্য পেনসন ফান্ডে। অবশিষ্ট অর্থ যায় শ্রমিকের পিএফ ফান্ডে। ৫৮ বছর বয়সে সেই শ্রমিক সুদ-সহ সব টাকা ফেরত পাবেন। সঙ্গে পাবেন জমানো টাকার ১০ শতাংশ হারে আজীবন পেনসন।
শুধু ওই বিড়ি শ্রমিক নিজেই নন, পেনসনের সুবিধা পাবেন তার বিধবা স্ত্রী বা স্বামী (যদি মহিলা হন শ্রমিক), প্রতিবন্ধী সদস্য, অবিবাহিত মহিলারাও। শর্ত একটাই কমপক্ষে ১০ বছর প্রভিডেন্ড ফান্ডে টাকা জমা দিতে হবে। টাকার অঙ্ক যত বাড়বে, পেনসনের পরিমাণও তত বাড়বে। শ্রমিকেরা তত বেশি লাভবান হবে। শ্রমিকের জমা টাকার সম পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হবে বিড়ি মালিককেও। সমস্যাটা এইখানেই।
অভিযোগ এক শ্রেণির বিড়ি মালিক ও দালালদের প্ররোচনায় গরিব আনপড় বিড়ি শ্রমিক তাদের নিজেদের জমানো প্রভিডেন্ডের টাকা দশ বছরে পেনশন প্রকল্পে আসার আগেই তুলে নিচ্ছেন। আখেরে এতে ক্ষতি হচ্ছে শ্রমিকদেরই। কীভাবে?
ধরা যাক এক জন বিড়ি শ্রমিক ৭ বছর ধরে তার মজুরি থেকে নিয়ম করে ১০ হাজার টাকা জমিয়ে ছিলেন। ওই শ্রমিক যদি ৫৮ বছরে তার অবসরের আগেই সেই জমানো সমস্ত টাকা তুলে নেন তাহলে ওই শ্রমিক শুধুমাত্র তার জমানো টাকাটাই ফেরত পাবেন। বিড়ি মালিককে ওই শ্রমিকের জন্য এক পয়সাও প্রভিডেন্ড খাতে জমা দিতে হবে না। সিটুর বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য কমিটির সদস্য চিত্তরঞ্জন সরকার বলেন, “প্রতিটি শ্রমিক পরিবারেরই অভাবের সংসার। সেই সুযোগে বিড়ি মালিক, মুনশি, দালাল সকলেই নানাভাবে সময়ের আগেই বিড়ি শ্রমিকদের পিএফ খাতের সঞ্চয় তুলে নিতে বলছেন।’’
গরিব অশিক্ষিত শ্রমিকেরা তারই ফল ভুগছেন। আইএনটিইউসির বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, “অশিক্ষা ও দারিদ্রই হচ্ছে সব সমস্যার মূল। তারই সুযোগ নেয় দালালেরা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy