Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মাদ্রাসায় প্রথম বিড়ি মহল্লার অচেনা কন্যা

‘নোশিফা তুই কত্ত নম্বর পাইস রে!’

পাড়া-পড়শি সেই অবাক করা গলায় বিড় বিড় করছেন— চেনা মেয়েটার ভিতরে এমন অচেনা ক্ষমতা ছিল কেউ বুঝতেই পারিনি!  

মায়ের সঙ্গে বসে বাড়িতে বিড়ি বাঁধছে নোশিফা। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

মায়ের সঙ্গে বসে বাড়িতে বিড়ি বাঁধছে নোশিফা। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা 
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২০ ০৪:০৩
Share: Save:

মোবাইলে চোখে গেঁথে উঠোনে হুড়মুড়িয়ে নেমে এসেছিল দাদা, ‘ও নোশিফা তুই কত্ত নম্বর পাইস রে, দেখস!’ তখনও তার কাছে অস্পষ্ট প্রথম হওয়ার বিস্ময়। ক্লাসে কখনও প্রথম হয়নি সে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে, এক বার দ্বিতীয় হওয়ায় নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। উঠোন জড়ে ছড়িয়ে থাকা এক রাশ বিড়ি বাঁধার ফাঁকে মেয়েটি বলছে, ‘‘জানেন, এ বারও চমকে গিয়েছি। এক্কেবারে ফার্স্ট, কেমন যেন ভয় ভয় করছিল!’’ জঙ্গিপুরের খাশ বিড়ি মহল্লার নোশিফা খাতুন হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় প্রথম হয়ে শুধু নিজেই নয়, অবাক করে দিয়েছে হতদরিদ্র প্রান্তিক এই মহল্লার মানুষজনকে। দুপুর থেকে তাকে দেখার জন্য তাই ভিড় ভেঙেছে নোশিফাদের ছাপোষা উঠোনে। পাড়া-পড়শি সেই অবাক করা গলায় বিড় বিড় করছেন— চেনা মেয়েটার ভিতরে এমন অচেনা ক্ষমতা ছিল কেউ বুঝতেই পারিনি!

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মুনিরিয়া হাইমাদ্রাসার শিক্ষকেরাও খানিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘পড়াশোনা করত, ক্লাসেও আসত, তা বলে ওই বিড়ি বাঁধা মেয়েটা যে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দেবে সত্যিই ভাবিনি।’’ বৃহস্পতিবার, তার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তাই মনে হচ্ছিল, অচেনা বিড়ি মহল্লাটা যেন তাকে আঁকড়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে।

এ দিনও সকালে মায়ের সঙ্গে বসে বিড়িও বেঁধেছে সে। বলছে, ‘‘বৃহস্পতিবার ফল বের, চাপা একটা উৎকণ্ঠা ছিল। রাতে ঠিকমত ঘুমোতেও পারিনি। বেলা বারোটা নাগাদ দাদা মোবাইলে নেট ঘেঁটে জানাল, ‘ও নোশিফা তোর রেজাল্ট জ়ান, ৭৭১ পাইস’, তখনও জানি না আমিই প্রথম হয়েছি।’’ একটু পরে বাড়িতে ফোন করে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জানান, হ্যাঁ সেই ‘ফার্স্ট!’ অনামী মাদ্রাসা থেকে প্রথম হওয়া অচেনা বিড়ি মহল্লার নোশিফার প্রিয় বিষয় ইংরাজি। ইংরাজি নিয়েই পড়তে চায় সে। তবে এখনও জানে না কোথায় ভর্তি হবে সে। তবে সেই অনিশ্চয়তার মাঝে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে তার। বাবা তৈয়ব শেখ পেশায় রাজমিস্ত্রি,মা জসেনুর বিবি বাড়িতে বিড়ি বাঁধেন। তবে রুজির টানে তৈয়ব এখন বর্ধমানে। নোশিফা বলে, ‘‘আব্বাকে খবরটা জানাতেই কেঁদে ফেলল জানেন!’’

দাদা সঞ্জু কলেজে ভর্তি হয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায় জড়িয়ে পড়াশুনোয় ইতি টানেন। বলছেন, ‘‘বোনটা পড়ছে, এই ভাল, আমার আর হল না।’’ দিদি সাবনুর তৃতীয় বর্ষে পড়ে জঙ্গিপুর কলেজে। শিক্ষায় পরশ বলতে এটুকুই। নোশিফার এই সাফল্যের পিছনে তার বাবা অবশ্য সব কৃতিত্বই দিচ্ছেন, তার মাকে। বর্ধমান থেকে ফোনে বলছেন, ‘‘পঞ্চম শ্রেণিতেই ইতি পড়েছিল ওর মায়ের পড়াশুনোয়। কিন্তু ও না থাকলে মেয়েটা এত দূর এগোতেই পারত না।’’ আর মা দু’চোখ জল নিয়ে মেয়েকে জাপ্টে ধরে বলছেন, ‘‘মেয়েটা যে এমন করে কথা রাখবে, গোটা জঙ্গিপুরের মুখ উজ্জ্বল করবে ভাবিনি গো!’’

উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল সম্পর্কিত যাবতীয় আপডেট পেতে রেজিস্টার করুন এখানে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madrasha examination worker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE