Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইমামের কথায় বিয়ে আটকাল নাবালিকার

খবর পেয়ে যখন পৌঁছন ব্লক প্রশাসনের লোকজন, ততক্ষণে গায়ে-হলুদ হয়ে গিয়েছে বছর চোদ্দোর কিশোরীর। বিয়ে বন্ধের কোনও কথাই কানে তুলছিলেন না পরিবারের লোকেরা। পাত্রী হুমকি দিচ্ছিল, বিয়ে না হলে মণ্ডপেই গায়ে আগুন দেবে সে। অবশেষে স্থানীয় ইমামদের বোঝানোয় গোঁ ভাঙল মেয়ের বাড়ির। শুক্রবার মুর্শিদাবাদের শক্তিপুরের ছুতারপাড়ায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে রুখলেন ইমামরাই।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ০১:৩৬
Share: Save:

খবর পেয়ে যখন পৌঁছন ব্লক প্রশাসনের লোকজন, ততক্ষণে গায়ে-হলুদ হয়ে গিয়েছে বছর চোদ্দোর কিশোরীর। বিয়ে বন্ধের কোনও কথাই কানে তুলছিলেন না পরিবারের লোকেরা। পাত্রী হুমকি দিচ্ছিল, বিয়ে না হলে মণ্ডপেই গায়ে আগুন দেবে সে। অবশেষে স্থানীয় ইমামদের বোঝানোয় গোঁ ভাঙল মেয়ের বাড়ির। শুক্রবার মুর্শিদাবাদের শক্তিপুরের ছুতারপাড়ায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে রুখলেন ইমামরাই।

বাল্যবিবাহ বন্ধে ইমামদের সদর্থক এই ভূমিকায় সাড়া পড়েছে এলাকায়। বেলডাঙা-২ ব্লকের ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হাফিজ সামসুল হুদা অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরা এর আগেও দু’টো নাবালিকা বিয়ে রুখেছি।” তাঁর কথায়, “চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি অল্প বয়সে বিয়ের কুফলগুলো। প্রসবের সময় মৃত্যু হচ্ছে মেয়েদের। শরীর ভেঙে পড়ছে। তা ছাড়া আমাদের সম্প্রদায়ে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হারও যথেষ্ট কম। আমরা যদি এগুলোর প্রতিবাদ না করি, দেখবে কে?”

মুর্শিদাবাদে বাল্যবিবাহের হার অন্য জেলাগুলোর তুলনায় বেশি। ডোমকল, বেলডাঙার মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জায়গায় সেটা আরও এক ধাপ উপরে। ছুতারপাড়ার নিম্ন-মধ্যবিত্ত ওই পরিবারটি তাদের বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। ১৪ বছরের ছোট মেয়ের জন্য বিদেশে কর্মরত তুলনায় সচ্ছল পাত্র আসায় হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন মেয়ের বাবা। চেয়েচিন্তে বিয়ের যাবতীয় আয়োজন করেছিলেন সাধ্যমতো। বিয়ের আগের দিন, বৃহস্পতিবার সবে উদয়চাঁদপুর থেকে ছেলের বাড়ির হলুদ গায়ে পড়েছে মেয়ের, আচমকাই দোরগোড়ায় বেলডাঙা-২ ব্লক প্রশাসনের দুই প্রতিনিধি। তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেন, অল্প বয়সে বিয়ে দিলে শুধু মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ নয়, শারীরিক নানা সমস্যা হবে। অপরিণত বয়সে ছেলে-মেয়ে হলে তাদেরও সমস্যা হবে। পাত্রীর বাবা যুক্তি সাজান, “আমি রাজমিস্ত্রি। কত কষ্ট করে এই আয়োজন করেছি আমিই জানি। বিয়ে ভেস্তে গেলে লোকসান মেটাবে কে?” লাজ-লজ্জা ভুলে পাত্রী এগিয়ে এসে বলে, “মন যখন একবার দিয়েছি, বিয়ে করবই। গায়ে হলুদ না হলেও ভাবা যেত। কিন্তু হবু স্বামীর হলুদ গায়ে ঠেকেছে। আর কিছু করার নেই। যদি বিয়ে না হয়, মণ্ডপের নীচে দাঁড়িয়ে গায়ে আগুন দেব।”

একরত্তি মেয়েটির একরোখা সেই কথা শুনে ফিরে আসেন ব্লক প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। তবে, হাল ছাড়েননি বিডিও অরিজিৎ মুখোপাধ্যায়। স্থানীয় ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হাফিজ সামসুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। সামসুল হুদা বলেন, ‘‘এলাকার দশ জন ইমামকে ডেকে পাঠিয়ে বিস্তর আলোচনা করি। আমরা একমত ছিলাম এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। মেয়ের বাড়িকে সেটা বোঝানোটা চ্যালেঞ্জ ছিল।”

বিয়ের দিন, শুক্রবার দলবল বেঁধে ইমামরা যান মেয়ের বাড়ি। বাড়ি ভর্তি তখন আত্মীয়স্বজন। রান্নার জোগাড় চলছে জোরকদমে। একসঙ্গে ১০ জন ইমামকে দেখে প্রথমটায় ঘাবড়ে যান বাড়ির লোকেরা। পাত্রীর ১৮ বছরের বিবাহিতা দিদিকে দেখিয়ে ইমাম কামরুজ্জামান বলেন, “অল্প বয়সে বিয়ের পরিণতি তো সামনেই দেখছ। গত পাঁচ বছরে দিদির স্বাস্থ্য যে ভাবে ভেঙে পড়েছে, তা পূরণ হবে কোনও দিন?” মেয়ের মুখে কোনও উত্তর নেই। ‘কিন্তু কিন্তু’ করে মেয়ের বাবা বলেন, ‘‘গায়ে-হলুদ হয়ে গিয়েছে। এখন বিয়ে বন্ধ হলে সমাজ একঘরে করবে যে।” সামসুল হক-সহ রামপাড়া, বাছরা, কাশিপুর, আন্দুলবেড়িয়া, দাদপুর, সোমপাড়া থেকে আসা ইমামরা শরিয়তের উল্লেখ করে আশ্বস্ত করেন, “কোনও সমস্যা হবে না।”

এরপরই গোঁ ভাঙে মেয়ের বাড়ির। বন্ধ হয়ে যায় বিয়ে। সামসুল হক বলেন, ‘‘মেয়ে শেষ পর্যন্ত ভুল বুঝতে পেরেছে। সোমবার থেকে সে স্কুলে যাবে বলে আমাদের জানিয়েছে।

স্বস্তিতে প্রশাসনও। বিডিও অরিজিৎবাবু বলেন, “আমরা বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা পারেননি। অন্তত ইমামের কথাটা যে ওরা শুনল, এতেই আমরা খুশি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE