Advertisement
১৭ মে ২০২৪

কর্মী কম, সব দরজা খুলছে না হাজারদুয়ারির

কর্মী-সঙ্কটে দুয়ার বন্ধ হাজারদুয়ারিরএক-এক দিন এক-একটা। কখনও একাধিক। ইতিহাসের গন্ধমাখা মুর্শিদাবাদের লালবাদে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ দেখতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় এই হাজারদুয়ারির সব ক’টি গ্যালারি খুলছে না ইদানীং। এমনকী গত ৩০ জুলাই (ঈদের পরের দিন) প্রায় ১৪ হাজার পর্যটকের ভিড় সামলাতে না পেরে আকর্ষণের মূল কেন্দ্র অস্ত্রাগার-ও বন্ধ করে দিয়েছিলেন মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ।

শুভাশিস সৈয়দ
লালবাগ শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০১:৩৭
Share: Save:

কর্মী-সঙ্কটে দুয়ার বন্ধ হাজারদুয়ারিরএক-এক দিন এক-একটা। কখনও একাধিক।

ইতিহাসের গন্ধমাখা মুর্শিদাবাদের লালবাদে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ দেখতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় এই হাজারদুয়ারির সব ক’টি গ্যালারি খুলছে না ইদানীং। এমনকী গত ৩০ জুলাই (ঈদের পরের দিন) প্রায় ১৪ হাজার পর্যটকের ভিড় সামলাতে না পেরে আকর্ষণের মূল কেন্দ্র অস্ত্রাগার-ও বন্ধ করে দিয়েছিলেন মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। দেখার সাধ সম্পূর্ণ না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে। বিরক্তি চেপে রাখছেন না হাজায়দুয়ারি নির্ভর মুর্শিদাবাদের পর্যটন-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও।

গ্যালারি বন্ধ রাখার পিছনে ‘কর্মী সংখ্যা কম’ থাকার সাফাই দিয়েছেন মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা পুরাতত্ত্ববিদ নয়ন চক্রবর্তী বলেন, “২১টি গ্যালারির জন্য ৪২ জন কর্মী থাকার প্রয়োজন। সেখানে রয়েছেন মাত্র ২১ জন। তার মধ্যে প্রতিদিনই ছুটি থাকে ৪-৫ জনের। ফলে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫-১৬ জনে। নিরাপত্তার কারণেই প্রতিটি গ্যালারি খোলা সম্ভব হয় না।”

মিউজিয়ামের কর্মীদের আবার অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের দিকে। তাঁদের অভিযোগ, গত ২৫ জুলাই থেকে মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়ন চক্রবর্তী বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য ছুটিতে রয়েছেন। হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামের অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিওলজিস্ট পদে রয়েছেন সঙ্গীতা চক্রবর্তী। তিনিও গত ২৫ জুলাই থেকেই ‘ছুটি’তে রয়েছেন। ফলে হাজারদুয়ারি মিউজিয়াম ‘অভিভাবকহীন’ অবস্থায় হয়ে পড়েছে।

মিউজিয়ামে কর্মী কম মেনে নিলেও গ্যালারি বন্ধ থাকার কথা জানা নেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (কলকাতা মণ্ডল) পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা এ কে পটেলের। তিনি বলেন, “মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরাতত্ত্ববিদকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বাইরে পাঠানো রয়েছে। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে গ্যালারি বন্ধ রাখার বিষয়টি জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”

নবাব নাজিম হুমায়ুন জাঁ হাজারদুয়ারি প্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। স্থপতি জেনারেল ম্যাকলয়েড ডানকানের পরিকল্পনায় ওই প্রাসাদ (১৮২৯-১৮৩৭ খ্রীষ্টাব্দ) নির্মিত হয়। পরে ১৯৮০-র দশকে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (কলকাতা মণ্ডল) ওই হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও মিউজিয়াম অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণের পরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মিউজিয়ামে ২১টি গ্যালারি তৈরি করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেয়। ওই গ্যালারিগুলির মধ্যে রয়েছেঅস্ত্রাগার, আর্কাইভ, আর্ট গ্যালারি, পেন্টিং, লাইব্রেরি, দরবার কক্ষ, বিলিয়ার্ড রুম, রিলিজিয়াস গ্যালারি, প্রিন্স গ্যালারি, প্যাট্রিয়ট গ্যালারি।

এক তলায় অস্ত্রাগার গ্যালারিতে প্রায় ২৬০০টি অস্ত্র সজ্জিত আছেতার মধ্যে এমন অস্ত্রও রয়েছে, যা পলাশি যুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। এছাড়াও আলিবর্দি খাঁয়ের ব্যবহার করা তলোয়ার ও বহু নল বিশিষ্ট বন্দুক, নাদির শাহের শিরস্ত্রাণ, মীরকাশিমের ছোরা, বিভিন্ন ধরণের কামান ও ছোরাএমনকী যে ছোরা দিয়ে সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটিও ওই গ্যালারিতে ঠাঁই পেয়েছে। দোতলায় বিভিন্ন আর্ট গালারিতে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মার্বেল পাথরের সিংহাসন, সিরাজদ্দৌলার রূপার পালকি, পানপাত্র, চিনামাটির বিভিন্ন রকমের ফুলদানি, হাতির দাঁতের সোফাসেট ও পালকি, রূপার পালকি, নবাবদের ব্যবহার করা বিলিয়ার্ড বোর্ড, ম্যাজিক আয়না, মমি করা দুষ্প্রাপ্য পাখি। দরবার কক্ষে রয়েছে ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া ১০১টি বাতির সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। হারুণ অল রশিদের স্বহস্তে লিখিত ১০ ইঞ্চি লম্বা ও ৬ ইঞ্চি চওড়া একত্রিশ পাতার কোরান ও আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী’র পাণ্ডুলিপি।

মিউজিয়াম সূত্রে জানা গিয়েছে, হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামে এই মুহূর্তে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারেন্টেন্ডিং আর্কিওলজিস্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিওলজিস্ট, তিন জন করণিক-সহ মোট ৫৩ জন কর্মী রয়েছেন। মিউজিয়ামের এক কর্মী জানান, ২১টি গ্যালারি দেখভালের জন্য রয়েছে ২৩ জন। দু’জন রয়েছেন বিভিন্ন গ্যালারির দরজা খোলা ও বন্ধ করার জন্য। আর আছেন কিছু অস্থায়ী কর্মী। কিন্তু বিশাল প্রাসাদের দেখভাল করার জন্য এই সংখ্যা মোটেই যথেষ্ট নয়। ফলে মাঝে-মধ্যেই বন্ধ থাকছে বিভিন্ন গ্যালারি। কর্মী ঘাটতির কারণ দেখিয়ে গত এক বছর ধরে গ্রন্থাগারও খোলা হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রন্থাগারে আছে উর্দু, ইংরেজি, আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত প্রায় ১২০০০ দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। ইতিহাস চর্চাবিদ খাজিম আহমেদের কথায়, “ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যসম্পন্ন এত বড় গ্রন্থাগার গোটা পূর্ব ভারতে নেই।” জানা গিয়েছে গ্রন্থাগারিক আবদুল রব মোল্লা বদলি হয়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার পর থেকেই বন্ধ গ্রন্থাগার। এমনকী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও করা হয় না। নয়ন চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “ওই গ্রন্থাগারে প্রথম থেকেই সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তাই খোলা না হলেও প্রতিদিন ভেতর থেকে জানালা-দরজা খুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।”

হাজারদুয়ারি নিয়ে আরও নানা অভিযোগ রয়েছে। যেমন, হলুদ মসজিদ থেকে ব্রীজঘাট পর্যন্ত চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি রাস্তা ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়ার মাঝে বাগানে পর্যাপ্ত আলো নেই। এই সব অব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়াচ্ছে ক্রমশ। ক্ষুব্ধ স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। লালবাগ সিটি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি স্বপনকুমার ভট্টাচার্য বলেন, “প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রী হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামের টানে মুর্শিদাবাদ শহরে ভিড় করেন। এখন গ্যালারি বন্ধ থাকলে তাঁদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। তাঁরা যদি মুর্শিদাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে পর্যটন শিল্প মার খাবে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE