গাঁয়ের ইস্কুলে ছিলেন অঙ্কের মাস্টারমশাই। শহরের স্কুলে এসে পড়াতেন ইংরেজি! স্নাতক বিজ্ঞানের। তার পরে ডবল এমএ ইংরেজি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে! সঙ্গে আবার বিএড-ও। বছরভর এখনও পড়াশোনা আর লেখালেখিতে ডুবে থাকেন। আর পাঁচ বছর অন্তর লোকসভা ভোট এলেই নাকে দড়ি দিয়ে দৌড়!
এ বার দৌড়ের শেষ ল্যাপে এসে দেখছেন, প্রচারের আরও কিছু খরচ দলের ছেলেদের হাতে তুলে না দিলেই নয়। নির্বাচন কমিশনের বিধি মেনে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে হবে চেকেই। চেক বইয়ের পাতাই কি না এই সময়ে গিয়েছে ফুরিয়ে! সকাল সকাল ব্যাঙ্ক থেকে পোস্ট অফিস চক্কর কাটছেন গৃহিনী। পিলখানা রোডের চকোলেট রঙা বাড়ির বসার ঘরে গৃহকর্তা অধীর হয়ে উঠছেন। প্রচার শুরু করার ডাক আসছে যে ঘনঘন!
প্রতি বার ডাক আসে আর তিনি সাড়া দেন। হারের হ্যাটট্রিকও হয়ে গিয়েছে। তবু এমন রবার্ট ব্রুস-সুলভ ধৈর্য আসে কোথা থেকে! প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় হাসেন। “কত কিছু ছেড়ে এসেছি রাজনীতির জন্য। এত বার জিতেছি, হেরেছি। এ সব এখন আমার কাছে রাস্তায় বেরিয়ে গায়ে ধুলো লাগার মতো! ফিরে এসে জল ঢেলে ধুয়ে নিলাম, মিটে গেল!” সহজ তত্ত্ব তাঁর। কবি কবি চেহারা, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, তবুু প্রমথেশবাবুর নামটা মুছে যাবে না। হারের হ্যাটট্রিকের আগে এই বহরমপুরেই তাঁর জয়ের হ্যাটট্ট্রিকও ইতিহাসের খাতায় উঠে আছে যে! প্রয়াত ত্রিদিব চৌধুরীর খাস তালুকে ১৯৯৪ সালে উপনির্বাচনে আরএসপি প্রার্থী হিসাবে আপাদমস্তক ভদ্রলোক প্রমথেশবাবুর প্রথম জয়। পরে ১৯৯৬ ও ’৯৮-এ আরও দু’টো লোকসভা ভোটে সাংসদ। কিন্তু কপাল এমনই, তিন বার জিতেও সাংসদ জীবনের মেয়াদ মাত্র সাড়ে চার বছর! “যখনই জিতেছি, কোনও না কোনও কারণে দ্রুত আবার অকাল নির্বাচন এসে পড়েছে!” হাসতে হাসতেই বলেন প্রমথেশবাবু। তাঁকে তিন বার হারিয়ে যিনি সাংসদ, তিনি কিন্তু পেয়েছেন পাক্কা ১৫ বছরই!
মাস্টারমশাইয়ের দল এ বার তাঁর পুরনো সাবজেক্ট অঙ্কের উপরেই কিঞ্চিৎ ভরসা রাখছে। আরএসপি-র মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি বলছে, দেশ জুড়ে কংগ্রেস-বিরোধী এবং নরেন্দ্র মোদীর নামে হাওয়া বহরমপুুরের সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়বে কেন? এই হাওয়ার অঙ্কে কংগ্রেসের ভোট যদি কিছু কমে, বিজেপি-র যদি কিছু বাড়ে এবং বাজারে নেমে তৃণমূল যদি কিছু ভোট কেটে নেয়, তা হলেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীরা এসে পড়বেন একে অপরের কাছাকাছি! একই রকম অঙ্ক কষে অধীর হয়ে উঠছেন দেবেশ অধিকারীও। প্রমথেশবাবুু ১৯৯৮-এ যে বার জিতেছিলেন, দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন বিজেপি-র (অধুনা তৃণমূলে) সব্যসাচী বাগচী। এ বারের বিজেপি প্রার্থী দেবেশবাবু তাই বলতে পারছেন, “এখন তো মোদীর হাওয়া। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ বার আমাদের দিকে। সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়েও এটাই অনুভব করেছি।”
ঠিক কী অনুভব করে বলা মুশকিল, তবে ইন্দ্রনীল সেন আরও বেশি অধীর! তাঁর মনে হচ্ছে, “বর্তমান সাংসদের দাদাগিরি ১৬ মে-র পরে আর থাকবে না! কেউ বরদাস্ত করবে না!” তৃণমূল প্রার্থী কোথায় কেমন ভাবে থাকছেন, জেলার গোষ্ঠী-বিবাদে তিতিবিরক্ত হয়ে কখন কী বলে ফেলেছেন, এমনকী রাতে কেমন পোশাকে শুতে যাচ্ছেন, মিডিয়ার কল্যাণে কিছুই এ বার বাজারে আসতে বাকি নেই! এ বার পঁচিশে বৈশাখ বহরমপুর জুড়ে ইন্দ্রনীলেরই গান বাজিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে তৃণমূল। রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনও হল, আবার প্রার্থীর হয়ে প্রচারও হয়ে থাকল! কলকাতা থেকে এসে শিল্পী-গায়ক-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ইন্দ্রনীলের পক্ষে ভোট-আবেদন করতে দেখছে বহরমপুর। তাঁদের বক্তব্যের নমুনা? মাইক হাতে ফিল্মি কায়দায় গলা উঠিয়ে-নামিয়ে এক অভিনেতা বলেছেন, “৩৪ বছর একটা সরকার ছিল। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলত না, বলতে দিত না। তাদের ভাষা ছিল চিনা, রুশ, ভিয়েতনামি!” শুনে জনতার ফিসফাস, “পরের বার টিকিটটা নেবে মনে হচ্ছে গো!” সে সব অবশ্য প্রার্থীর কানে পৌঁছয়নি। জনগণের জন্য গায়ক-প্রার্থী বরং বার্তা দিচ্ছেন, “আমি এর মধ্যে আপনাদের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছি। দিদির সামনে কথা দিচ্ছি, শুধু ভোটের সময় দু’মাসের জন্য আসিনি। আপনাদের ভোটে জয়যুক্ত হয়ে পাঁচ বছর সকাল-বিকাল-রাত পাশে থাকব।”
এমন প্রার্থীকে বহরমপুরের মতো আসনে লড়তে পাঠিয়েছেন যিনি, তিনিও তো অধীর হবেনই! শেষ লগ্নে তাই কান্দি, বহরমপুর, বেলডাঙা উড়ে বেড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কান্দি ছাড়া কোথাও মাঠ ভরেনি, সে না হয় ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ‘সংস্কৃতিবান যুবক’ প্রার্থীকে দেখিয়ে তাঁর নেত্রী তথা দিদি প্রশ্ন তুুলেছেন, ইন্দ্রনীলকে দেখে কি মনে হয়, ও কাউকে চুুল্লিতে ঠেলে দিয়ে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেবে? কাউকে মাছের পেটে দেবে? গুন্ডামি করবে? সঙ্গে বহরমপুরের বর্তমান সাংসদকে প্রবল ব্যক্তিগত আক্রমণ। নাম না-করেই তৃণমূল নেত্রীর হুঁশিয়ারি, “এ বার খেলা অত সহজ নয়! ভয় দেখিয়ে, ম্যানেজ করে আর ড্যামেজ কন্ট্রোল করা যাবে না! বহরমপুর কারও জমিদারি নাকি?”
জেলখানার উল্টো দিকে কংগ্রেস ভবন থেকে প্রায় আড়াইশো ‘টুকটুক’ (ব্যাটারি-চালিত চার চাকার রিকশা) নিয়ে যে অভিনব মিছিল বহরমপুর বিধানসভা এলাকা পরিক্রমায় বেরিয়েছে, তার চেহারা দেখলে অবশ্য মনে হবে ‘জমিদারি’ই বটে! মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির কয়েক ঘণ্টা পরে বৈশাখী সন্ধ্যার মিছিলে মেলা লোক! সামনে হুডখোলা জিপে হাত নাড়ছেন যিনি, তিনি একেবারেই অধীর নন! উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন না অধীররঞ্জন চৌধুরী। টানা ১৫ বছর সাংসদ থেকে প্রত্যাশার চাপ বেড়েছে লোকের। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হওয়ায় এ বার দলের বাড়তি দায় এবং দায়িত্ব দুই-ই চেপেছে কাঁধে। এমনিতেই ভোটের সময় গ্লুকোজ-জল নিয়ে দৌড় নয়, বছরভর কাজে বিশ্বাসী। এ বার রাজ্য জুড়ে ছুটে বেড়াতে গিয়ে শেষের দিকে ছাড়া নিজের কেন্দ্রে আরওই সময় দিতে পারেননি। তবু বেলডাঙায় সকালের রোড শো-য় হোক, আর রাতে প্রচার শেষে কংগ্রেস ভবনে নিজের ঘরে একই রকম ধীর-স্থির বহরমপুরের সর্বজনীন ‘দাদা’। প্রতি বার ভোটের আগে তাঁর নামে কেস-কামারি হয়। কিন্তু এত ব্যক্তিগত আক্রমণ কখনও সামলেছেন? লিকার চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ডুবিয়ে ‘দাদা’ বলেন, “ও সব তো মাথা খারাপের কথা! সারদায় সিবিআই হয়ে মাথাটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে! যাকে যা পারছেন বলছেন!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সহাস্য কৌতূক, “আমি তো বলেছি, সিবিআই আসছে তেড়ে, পালা টিএমসি বাংলা ছেড়ে!”
সে না হয় ঠাট্টার কথা। বামেদের সিরিয়াস প্রচারে আছে কেন্দ্রীয় বাজেটে ৪৩৯ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়েও কান্দির মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত না হওয়ার কথা। আছে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পঞ্চাননতলা ও চুঁয়াপাড়ায় রেললাইনের উপরে উড়ালপুল না হওয়ার অভিযোগ। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীরের জবাব, “উড়ালপুলের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়ে টেন্ডার হয়ে গেল। কিন্তু রাজ্য পূর্ত দফতরের নো অবজেকশন আর এল না! এটা একটা সরকার?” কান্দি? “একই হাল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাশ হয়ে ৭৫% টাকা অনুমোদন হয়ে গেল। কিন্তু রাজ্য তার দায়িত্বটুুকু না পালন করায় কাজ এগোল না।”
অধীরের স্বস্তি, তাঁর কথা তাঁর কেন্দ্রের অনেক মানুষ এখনও শোনেন। বেলডাঙা থেকে রেজিনগর, নানা প্রান্তে তাঁর মিছিলে তেরঙা ঝান্ডা কাঁধে এখনও বিস্তর হতদরিদ্র মুখ। মলিন বেশে গাঁয়েগঞ্জের ছোটরা এখনও তাঁর মিছিলে নাচতে নাচতে সেই আদ্যিকালের স্লোগান আওড়ায়, ‘ভুট দেবেন কোনখানে, হাত চিহ্নের মাঝখানে’! সাংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই বহরমপুরের সিদ্ধার্থ তিওয়ারি যেমন বলেন, “বামেরা অনেক অন্যায় করেছে। কিন্তু অসৌজন্যে এই সরকারটা সব্বাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে! স্রেফ অধীরবাবুর নাম হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছেন!” আবার বেলডাঙার নজিবুর রহমান মত দেন, “বহরমপুুরে লড়তে এসে শুধু অধীর চৌধুরীকে এক তরফা আক্রমণ করে কোনও লাভ নেই! এটা তৃণমূল বুঝছে না।”
বহরমপুর বিলক্ষণ বুঝেছে, রাজ্য রাজনীতিতে ‘দাদা’র মর্যাদার লড়াই এখন ‘দিদি’র সঙ্গেই। বহরমপুুরের মনোজ চক্রবর্তী, কান্দির অপূর্ব (ডেভিড) সরকারের মতো কংগ্রেস বিধায়কেরা এ বার তাই ঠিক করেছেন, গত বারের ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ছাড়িয়ে দাদার মার্জিন দু’লাখের উপরে নিয়ে যাবেন! কংগ্রেস ভবনের সেই ঘরে এক জন আবদার করছিলেন, “এত কিছু বলছে এরা। দাদা, এ বার জিতে জয়টা তুুমি দিদিকে উৎসর্গ করো!”
মুচকি হেসে দাদা চায়ের পেয়ালা আবার তুলে নিলেন ঠোঁটে। ভোট বলে কথা। কাপে-ঠোঁটে ফারাক তো রাখা চলে না!