Advertisement
E-Paper

দিনে ডাকাতি মাটি মাফিয়ার, নীরব দর্শক পুলিশ

ভোরের কুয়াশা ফুঁড়ে ভাগীরথীর দিকে ছুটে চলেছে একের পর এক ট্রাক্টর। তারপর নদীর পাড়ে ঝপাঝপ কোদালের কোপ আর চাপা ফিসফাস। ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেলে মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে ইটভাটার উদ্দেশে মিলিয়ে যায় মাটি বোঝাই ট্রাক্টরগুলো। দু’-একদিনের ব্যাপার নয়, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের নদী লাগোয়া এলাকায় এমন দৃশ্য রোজদিনের। ওই দুই জেলা জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য বেআইনি ইটভাটায় মাটির জোগান দিতেই এমন ব্যবস্থা। অথচ ওই মাটি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পান না এলাকার বাসিন্দারা।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৭
ভৈরবে চলছে মাটি কাটা। ইসলামপুরে বিশ্বজিত্‌ রাউতের তোলা ছবি।

ভৈরবে চলছে মাটি কাটা। ইসলামপুরে বিশ্বজিত্‌ রাউতের তোলা ছবি।

ভোরের কুয়াশা ফুঁড়ে ভাগীরথীর দিকে ছুটে চলেছে একের পর এক ট্রাক্টর। তারপর নদীর পাড়ে ঝপাঝপ কোদালের কোপ আর চাপা ফিসফাস। ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেলে মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে ইটভাটার উদ্দেশে মিলিয়ে যায় মাটি বোঝাই ট্রাক্টরগুলো।

দু’-একদিনের ব্যাপার নয়, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের নদী লাগোয়া এলাকায় এমন দৃশ্য রোজদিনের। ওই দুই জেলা জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য বেআইনি ইটভাটায় মাটির জোগান দিতেই এমন ব্যবস্থা। অথচ ওই মাটি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পান না এলাকার বাসিন্দারা। বেলডাঙার মির্জাপুর মেলেনিঘাট, খাঁ পাড়া বাগানপাড়া এলাকায় অন্তত হাজার পাঁচেক মানুষের বাস। কাকভোরে তাঁদের ঘুম ভাঙে ওই ট্রাক্টরের শব্দে। ওই এলাকা থেকে ২০০ মিটার দূরে ভাগীরথীর বাঁধ। স্থানীয় বাসিন্দারা বাসিন্দারা সমস্বরে বলছেন, “কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নদীর পাড় থেকে যে ভাবে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে নদীর তো বারোটা বাজছেই। নদীর পাশে আমাদের জমিগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ কিছু বলতে গেলেই জোটে গালিগালাজ আর খুনের হুমকি।”

অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি সংস্কার দফতর সব জেনেও মাটি মাফিয়া কিংবা বেআইনি ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মির্জাপুরের এক চাষির কথায়, “নদীর পাড় থেকে মাটি কাটা চলছেই। মাঝেমধ্যে গরিব কৃষককে টাকার লোভ দেখিয়েও চাষের জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। ওদের কথায় রাজি না হলে গায়ের জোরে মাটি কাটছে। দিনকয়েক আগে আমাকে না জানিয়েই জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছিল। প্রতিবাদ করতেই হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দেয়। কিন্তু জমির যা ক্ষতি হয়ে গেল তা ওই টাকা ক্ষতিপূরণ হিসাবেও যথেষ্ট নয়। আবার বেশি কিছু বলতে গেলে কিংবা প্রশাসনের কাছে গেলেও অন্য বিপদ রয়েছে।” আর এক চাষি বলছেন, “প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েই বা কী হবে। ওরা তো সবই জানে।”

বেলডাঙা ১ বিডিও শুভ্রাংশু মণ্ডল বলেন, “চাষের জমি ও ভাগীরথীর পাড় থেকে বেআইনি ভাবে যে মাটি চুরি হচ্ছে সে ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। এই বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।” জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা আধিকারিক অরবিন্দ মিনা জানান, বেআইনি ভাবে নদী পাড়ের মাটি কেটে নেওয়ার ক্ষেত্রে জেলার ২৬টি ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের ব্লক আধিকারিকদের সুনির্দিষ্ট ভাবে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। যদিও মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে পুলিশকে দায়ী করে অরবিন্দবাবু বলেন, “অনেক সময়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ জানালেও পুলিশ প্রশাসন তেমন ব্যবস্থা নেয় না। এক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি রয়েছে।” জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর অবশ্য বলেন, “অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও জেলার কোন থানার পুলিশ পদক্ষেপ করেনি, তথ্য-সহ সুনির্দিষ্ট ভাবে জানালে সংশ্লিষ্ট থানার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তবে প্রশাসনের এই ‘ব্যবস্থা’ কিংবা ‘পদক্ষেপের’ বহর ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছেন দুই জেলার নদী পাড়ের মানুষ। বেশ কয়েক মাস আগে নদিয়ার তেহট্টে জমির মালিককে না জানিয়েই চাষের জমি খুড়ে মাটি কেটে নিয়ে গিয়েছিল মাটি মাফিয়ারা। ওই জমির মালিকের ভাই পেশায় কলকাতা পুলিশের আধিকারিক। তিনি নিজে এসে তেহট্ট থানায় ও স্থানীয় ভূমি সংস্কার দফতরে নির্দিষ্ট ভাবে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যথারীতি পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কলকাতা পুলিশের ওই কর্মী আক্ষেপ করেই বলছিলেন, “নিজে পুলিশ পরিচয় দিয়েও যদি এমন হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী হয় সেটা ভালই বুঝতে পারলাম।”

শুধু ভাগীরথীই নয়, মাটি মাফিয়াদের নজর থেকে বাদ পড়ছে না পদ্মা, জলঙ্গি, ভৈরবের পাড়ও। যেমন ইসলামপুর থানা এলাকায় কোনও লুকোচুরি নেই, ভৈরবের পাড় থেকে প্রকাশ্যেই মাটি কেটে ট্রাক্টর বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, লুকোচুরি করার তো কোনও দরকারই নেই। কারণ, এখানে যা চলছে তা সবই ভূমি সংস্কার দফতর ও পুলিশ প্রশাসনের মদতেই। নদিয়ার ধুবুলিয়া এলাকায় দেবীপুর-পণ্ডিতপুর এলাকাতেও জলঙ্গির পাড়ের মাটি কেটে ট্রলারে করে জল পথেই মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ভাটায়। দেবীপুরের এক বাসিন্দার কথায়, “পণ্ডিতপুরে নদীর ধারের সব মাটি শেষ করে দিল গো।” আর সেই কারণেই কেবল বর্ষাতেই নয়, ভরা শীতেও বিপজ্জনক ভাবে ভাঙছে নদীর পাড়।” নদিয়ার তেহট্ট, কৃষ্ণগঞ্জ, চাপড়ার ন’মাইল, নবদ্বীপ, শিমুরালি, চাকদহ, রানাঘাট ও কল্যাণীর বিস্তীর্ণ এলাকাতেও চিত্রটা একই।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ায় বৈধ ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ২৩৩ টি। ২০০০ সালের ১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে যে সব ভাটা চালু হয়েছে সে গুলির সরকারি স্বীকৃতি নেই। নদিয়া জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সহ সম্পাদক অনীক কুণ্ডু বলেন, “আমাদের সংগঠনে শ’দুয়েক ভাটা রয়েছে। তবে আমরা নদীর পাড় কেটে মাটি কাটি না। কিন্তু বেআইনি ভাটাগুলো কোনও রাজস্ব দেয় না। ওরা কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করে ওরা যত্রতত্র মাটি কাটে।” জেলার একাধিক ব্লকের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আধিকারিকরা জানান, সিংহভাগ ভাটা মালিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকেন। ফলে সব জেনেও তাঁদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না।

মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রায় চারশো বৈধ ইট ভাটা রয়েছে বলে দাবি মুর্শিদাবাদ জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল বাকি শেখের। তিনি বলেন, “জেলায় এই মুহূর্তে প্রায় চারশো বৈধ ইঁট ভাটা রয়েছে। কিন্তু তার বাইরেও প্রায় তিনশো মত ইঁট ভাটা রয়েছে, যা অবৈধ ভাবে চলছে। আমাদের সাফ কথা, ইট ভাটাগুলি যদি সরকারি আইন মেনে না চলে তাহলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হোক। কিন্তু প্রশাসন অবৈধ ভাটাগুলি বন্ধ করছে না। সেই সুযোগ নিয়ে বেআইনি ইটভাটাগুলি যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।”

(সহ প্রতিবেদন: শুভাশিস সৈয়দ, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজাউদ্দিন, মনিরুল শেখ ও কল্লোল প্রামাণিক)

islampur robbery mafia police sebabrata mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy