লালবাগ নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন। নিজস্ব চিত্র
আর দশটা বছর গেলেই বয়স হবে দুই শতাব্দী। তবু রজতজয়ন্তী, সুর্বণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী, জন্মশতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষ পূর্তির কোনও অনুষ্ঠানই হয়নি এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভূ-ভারতে খুঁজে পাওয়া ভার।
কিন্তু ঘটেছে যে তেমনটাই। মুর্শিদাবাদের এক মাত্র সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লালবাগের ‘নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন’-এর কোনও প্রতিষ্ঠা দিবস আজ অবধি পালন করা হয়নি। সেই ইতিহাস শুধরে নিতে এ বার শিক্ষকমণ্ডলী ও স্কুলের প্রাক্তনীরা ঠিক করেছেন, আগামী ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি, তিন দিন ধরে মহাসমারোহে স্কুলের ১৯০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হবে। তার জন্য খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা। সরকারি দাক্ষিণ্যের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে রসিদ ছাপিয়ে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে অর্থ সংগ্রহ চলছে।
কিন্তু শুধু এত দিন প্রতিষ্ঠা দিবস পালন না হওয়াই নয়। অন্য দিক থেকেও এই স্কুলের ইতিহাস আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে আলাদা। কী সেই ইতিহাস?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বছর চারেক আগে, ১৮৫৩ সালে বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজ (তখন অবশ্য নাম ছিল বহরমপুর কলেজ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে কলেজের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ‘সেন্টিনরি ভ্যলিউম’ নামে ইতিহাসের একটি আকরগ্রন্থ প্রকাশ হয়। কৃষ্ণনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে মুর্শিদাবাদ তথা অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ মূল্যবান দলিল সেখানে প্রকাশিত হয়। সম্পাদকমণ্ডলীর সেই লেখা অনুসারে, এই জেলায় ১৮১৮ সালে ব্যাপটিস্ট মিশন সোসাইটি ২০০ ছাত্র নিয়ে তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ অচিরেই লুপ্ত হয়। ১৮২৪ সালের ৮ মার্চ লন্ডন মিশনারি সোসাইটি-র মিকাইয়া হিল ও মিসেস হিল মুর্শিদাবাদে আসেন। জেলায় তখন পাঁচটি বাংলা, একটি হিন্দুস্তানি এবং একটি পর্তুগিজ স্কুল ছিল। ১৮২৫ সালে ওই দুই মিশনারি এই জেলায় ছ’টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
এর ঠিক বছর দু’য়েক আগে, ১৮২৩ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব নাজিম ওয়ালা জা লালবাগে নিজের এবং সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানদের জন্য নিজামত কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই স্বপ্ন সফল হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। এর পরে নবাব নাজিম হন তাঁর পুত্র হুমায়ুন জা। উইলিয়াম লোচের রিপোর্ট মেনে তত্কালীন গভর্নর জেনারেল তাঁদের নিজামত কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেন ১৮২৫ সালের ২৭ মে। কৃষ্ণনাথ কলেজের ‘সেন্টিনরি ভ্যলিউম’ বলছে, “১৮২৬ সালে মুবারক মহলে নিজামত কলেজ চালু হয়। কলেজের বাত্সরিক খরচ ২০ হাজার টাকা। দেওয়া হয় নিজামত ডিপোজিট ফান্ড থেকে।”
প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পরেই, ১৮৩১ সালে নিজামত কলেজে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। রাজা গঙ্গাধর রায় তখন নবাব নিজামতের দেওয়ান। সেই সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সন্তানদের জন্যও কলেজের দরজা খুলে দেওয়া হয়। শতবার্ষিকী গ্রন্থ বলছে, ১৮৩৬ সালে ওই কলেজে ২৪ জন মুসলিম এবং ৩২ জন হিন্দু ছাত্র ছিল। কিন্তু এক শ্রেণির মুসলিম ছাড়া অন্যদের পড়ার অধিকার ফের রদ করা হয় ১৮৪৫ সালে। এর পরে পাশের ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। শেষমেশ ১৯০৯ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন’, সবার শিক্ষার জন্য দ্বার উন্মুক্ত হয়। উর্দু, আরবি, ফারসির পাশাপাশি ইংরেজি ও বাংলা পড়ানো হতে থাকে।
অতীত ঐতিহ্য মেনে এখনও এখানে পৃথক দু’টি বিভাগে বাংলা ও উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়া হয়। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়া করে নবাব পরিবারের উত্তরসূরীরা। অন্যেরা তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়ে। স্থায়ী প্রধান শিক্ষকের অভাবে ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সেই ভার সামলাচ্ছেন মহম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, “উর্দু ও বাংলা মাধ্যম মিলে মোট ছাত্র সংখ্যা ৮৮৫। শ্রেণি ৩২টি। সেখানে শিক্ষক-সংখ্যা সাকুল্যে ৩০। ছাত্রদের চিকিত্সার জন্য ডিসপেনসারি ছিল। শূন্যপদে দীর্ঘ দিন নিয়োগ না হওয়ায় তা তালাবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। নিজামত হস্টেলের রিলিজিয়াস টিচার ও লাইব্রেরিয়ান পদও কয়েক বছর ধরে শূন্য পড়ে রয়েছে।”
উর্দু ও বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো শুরু করার জন্য বছর দেড়েক আগে নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক না থাকায় তা-ও করা যায়নি বলে জানান ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক। তবে প্রথা ও বিধি মেনে স্কুলের নিজামত হস্টেলে থাকা নবাব পরিবারের ছেলেদের আজও প্রতি শনিবার বিরিয়ানি দেওয়া হয়। স্কুলবাড়ির ভিতরে নিজামত হস্টেলে কেবল নবাব পরিবারের উত্তরসূরীরাই থাকতে পারে। সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “নবাব মির জাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগমের দেওয়া এক কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজামত ডিপোজিট ফান্ড। সম্মিলিত ওই বিপুল ফান্ডের সুদ থেকেই নিজামত আমলে ও ব্রিটিশ আমলে কলেজের ও ছাত্রদের খরচ চলত। এখন সরকার চালায়।”
নিজামত হস্টেলে থাকা ছেলেদের খাবার, জামাকাপড়, বইপত্র, ধোপা-নাপিতের খরচ আজও বহন করতে হয় সরকারকে। কাছেই সাধারণ হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য রয়েছে পাশাপাশি দু’টি হস্টেল। সেগুলির ছাদ দিয়ে জল পড়ে। মেঝে দিয়েও জল ওঠে। কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ দত্ত এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। তাঁর আক্ষেপ, “বেশ কয়েক বছর আগে স্কুল ও হস্টেল সংস্কারের জন্য প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। সংস্কারের নামে ঐতিহাসিক ভবনের শাল ও সেগুন কাঠের কোটি টাকার সম্পত্তি লোপাট হয়েছে। কিন্তু হস্টেল সংস্কার হয়নি। হস্টেলের একটি অংশ ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। বাকিটাও ধ্বংসের মুখে।” আশার কথা একটাই। প্রতিষ্ঠা দিবসকে সামনে রেখে এ বারে সবাই একযোগে নেমেছেন। টাকা জোগাড় করা হচ্ছে। নানা পরিকল্পনা হচ্ছে। এক বার ঘুরে দাঁড়ানো গেলে আর দশ বছর পরে হয়তো ডাবল সেঞ্চুরির গৌরবে ফের ঝলমল করবে মর্যাদার এই প্রতিষ্ঠান।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর লালবাগ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy