বাসুদেবপুরে বিস্ফোরণে ভেঙে পড়েছে বাড়ি।
সমশেরগঞ্জের বাসুদেবপুরে বিস্ফোরণের ঘটনা ফের একবার মনে করিয়ে দিল কতটা নিরাপদ সীমান্তের এই এলাকা। শুধু ধুলিয়ানই নয়, লাগোয়া ফরাক্কা, সুতির মতো সীমান্ত এলাকায় সর্বত্রই ক্রমশ প্রকট হচ্ছে দুষ্কৃতীরাজ। যে ভাবে রাতদুপুরে পুলিশ ক্যাম্প থেকে সামান্য দূরে বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ল পাকা ছাদ ও দেওয়াল তা ভাবলেই শিউরে উঠছে বাসুদেবপুর।
এক দিকে জাল নোট, মাদকের রমরমা। অন্য দিকে, বোমা-বারুদের স্তুপ। দুয়ের সাঁড়াশি আক্রমণ যেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ফরাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সুতির গ্রামগঞ্জে নিরাপত্তার বাঁধনটা ক্রমশ আলগা করে দিচ্ছে। পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের উপরেও ইদানীং আর ভরসা রাখতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চোখের সামনে রাজনৈতিক ‘দাদা দিদিদের’ ছত্রছায়ায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা। যাদের জেল হাজতে থাকার কথা তারাই পুলিশের সামনে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকখানায়। আর সেই কারণেই অবাধে বাড়ছে জাল নোট, মাদক পাচারের কারবার। কখনও সেকেন্দ্রা, গিরিয়ায়, কখনও বা ইমামবাজার, বাসুদেবপুরে রোজ দিনই কোথাও না কোথাও বোমাবাজি এখন রোজনামচা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত দু’বছরে মুর্শিদাবাদ জেলায় অন্তত ২ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। ধরা পড়েছে অন্তত ২০০ জন। ধৃতদের ৬০ শতাংশই ধরা পড়েছে সামশেরগঞ্জ, ফরাক্কা ও সুতির বিভিন্ন এলাকা থেকে।
পুলিশ ও বিএসএফ সূত্রে জানা গিয়েছে, জাল নোটের কারবারের সবচেয়ে বড় করিডোর ধুলিয়ান ফেরিঘাট। ঘাটের ওপারেই মালদহের বৈষ্ণবনগর থানার পার-দেওনাপুর, শোভাপুর, পার-অনন্তপুর-সহ একাধিক গ্রামে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে জাল টাকা। সুযোগ বুঝে ধুলিয়ান ফেরিঘাট পার হয়ে ডাকবাংলো মোড় বা ধুলিয়ান রেল স্টেশন বা বাস যোগে সেই সব টাকা ঢুকছে কলকাত-সহ দক্ষিণবঙ্গে। কখনও আবার ফরাক্কা রেলস্টেশন হয়ে সেই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে দিল্লি, অসম, মুম্বইতে।
আগে নোটের কাগজ ও ছাপা দেখে সহজেই চেনা যেত জাল নোট। এখন খুব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে নোট ছাপানোর ফলে জাল নোট চেনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পুলিশকে। তবে শুধু পার-দেওনাপুরই নয়, সীমান্ত লাগোয়া মহব্বতপুর, চর-অনন্তপুর, শোভাপুর, হাজিনগর-সহ ৯টি গ্রামকে জাল নোটের কারবারের ঘাঁটি বলে চিহ্নিত করেছে বিএসএফ। জাল নোট বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে এই সব গ্রামে আসছে। সেখান থেকে তা বিভিন্ন পথ ধরে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। তাছাড়া লাখ দশেক টাকার জাল নোট আনা নেওয়া করা যায় অল্প জায়গার মধ্যে অতি সহজেই।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখছে পুলিশ। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
আবার ঝাড়খণ্ডের পথ ধরে আসছে বোমা তৈরির মশলা। সুতি, সামসেরগঞ্জ ও ফরাক্কার গ্রামগুলিতে যখনই কোনও সংঘর্ষ ঘটেছে তখনই যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বোমা। বুধবারই সুতির ইমামবাজারে মুড়ি মুড়কির মতো বোমা পড়েছে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সংঘর্ষে। কদিন আগেই ফরাক্কার শিবনগরে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে জুলুম শেখ নামে এক দুষ্কৃতীর। বটতলায় বোমাবাজির ঘটনা তো ফরাক্কায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেকেন্দ্রা ও গিরিয়াকে শান্ত করতে পুলিশ গত পাঁচ বছরে উদ্ধার করেছে অন্তত ২০ হাজার বোমা। সীমান্তের এই সব গ্রাম থেকে মাঝেমধ্যেই পুলিশ উদ্ধার করেছে শ’য়ে শ’য়ে বোমা। গ্রেফতারও হয়েছে অনেকেই। তারপরেও পরিস্থিতি যে তেমন বদলায়নি তা ফের প্রমাণ করে দিল বাসুদেবপুর। জঙ্গিপুরের এক আইনজীবী অশোক সাহা বলেন, “কোনও ক্ষেত্রেই এই সব মামলায় পুলিশ বোমা তৈরির মশলার ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে পারে না। এ ব্যাপারে পুলিশ তত্পর নয়। তাই সাজাও হয় না। তাছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার ফলে অনেক সময় বহু দুষ্কৃতী পার পেয়ে যায়। ”
তৃণমূলের জঙ্গিপুর লোকসভা এলাকার সভাপতি ও বিধায়ক ইমানি বিশ্বাসও নিজেই অভিযোগ করেছেন, “বাসুদেবপুরের ওই গুদামে বোমা মজুত ছিল। তা ফেটে গিয়েই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটেছে। পুলিশ তদন্তের আগেই কীভাবে এতটা নিশ্চিত হয়ে জানিয়ে দিল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বাইরে থেকে ছোড়া বোমায়? সীমান্ত এলাকায় এত বড় বিস্ফোরণের পুর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত। আশা করছি পুলিশ তা করবে।”
তৃণমুলের ব্লক সভাপতি হাবিবুর রহমানের প্রশ্ন, “বাইরে থেকে বোমা ছোড়া হলে গুদামে এত বারুদের গন্ধ কেন? পুলিশই বা কেন বিস্ফোরণের ৬ ঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে এল? এই দীর্ঘ সময় কেনই বা অরক্ষিত থাকল ওই ঘর? কেনইবা পুলিশ ছাদ ও দেওয়াল সরিয়ে মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করল না?” তিনি বলেন, “এলাকার তৃণমূল নেতা সুনীলবাবুকে কারা, কেনই বা মারতে চাইছেন সেটাও তো জানা দরকার।”
পাশেই বাংলাদেশ সীমান্ত। সামসেরগঞ্জ থানায় একসময়ে কাজ করা জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলছেন, “ওই সব এলাকায় বহু বাংলাদেশি এখনও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে অরঙ্গাবাদ মহলদারপাড়া ও ধুলিয়ান ফেরিঘাট দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে গা ঢাকা দেওয়া যায় খুব সহজে। প্রায় প্রতিদিনই তাদের দু’একজন করে ধরা পড়ছে।” তিনি বলেন, “সীমান্ত এলাকায় যে কোনও বিস্ফোরণই চিন্তার কারণ বইকি।” বিরোধী দল সিপিএম ও কংগ্রেসই শুধু নয়, তৃণমূলের নেতারাও উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি করেছেন বাসুদেবপুর বিস্ফোরণ কাণ্ডের। তৃণমূল নেতা জগন্নাথ চৌধুরী অবশ্য এ দিন বলেন, “বহু বার মিথ্যে অভিযোগ তুলে আমাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। এ বারেও সেটাই করা হচ্ছে। ওই ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিড়ি কোম্পানিকে। রাতে ঘরে কেউ থাকে না। বোমা ঘরে মজুত রাখা ছিল, না বাইরে থেকে ছোড়া হয়েছিল পুলিশ তা তদন্ত করে দেখুক। এতে আপত্তির কী আছে।” রাজনৈতিক চাপানউতোর চলতেই থাকবে। নিরাপত্তা আদৌ মিলবে কি না তা অবশ্য জানা নেই সীমান্তবাসীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy