মাত্র আড়াই বছর কাটাতে পারলেই কংগ্রেস বিধায়ক হিসেবে রজতজয়ন্তী পালন করার কথা ছিল। ২০১৫-য় শান্তিপুরের কংগ্রেস পুরপ্রধান হিসেবেও পঁচিশ বছর পূর্ণ হতো। ২০১৩-র ২৫ নভেম্বর সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এক সময় প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম প্রবীণ সহ-সভাপতি অজয় দে-র সে নজির গড়া হল না। উল্টে কংগ্রেস ছেড়ে তাঁর তৃণমূলে যোগদান শান্তিপুরে ডেকে এনেছে বিধানসভার অকাল-নির্বাচন।
আর এই উপ-নির্বাচনে (১২ মে) তৃণমূল প্রার্থী অজয় দে-র বিরোধী হিসেবে যেন ক্রমশ বড় হয়ে উঠছেন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা অজয় দে। ভেবেছিলেন, তৃণমূলের প্রবল হাওয়ায় শান্তিপুর থেকেও খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে কংগ্রেস। কিন্তু শান্তিপুরের ভাল-মন্দের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা পাঁচ বারের কংগ্রেস বিধায়ক তথা পুরপ্রধানের ‘ছায়া’ই যে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে, সেটা সম্ভবত আঁচ করতে পারেননি তিনি।
শান্তিপুরে গত আড়াই দশক ধরে অজয় দে আর কংগ্রেস যেন সমার্থক ছিল। পাঁচ-পাঁচটি বিধানসভা, পুরভোটে কংগ্রেসেকে সসম্মানে উতরে দিয়েছেন। ২০১০-এর পুরভোটে তাঁর নেতৃত্বে ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টিই কংগ্রেস পায়। মাত্র দু’টি ওয়ার্ডে জিতেছিল বামেরা। ২০১১-র নির্বাচনে ৩৮ হাজারের বেশি ভোটে জেতেন। স্থানীয় রাজনীতির সে সব হিসেব ওলটপালট করে দিয়েছেন অজয়বাবু নিজেই।
কংগ্রেসে থাকতেও অজয়বাবুর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়ের সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। সে কথা কবুল করে তিনি নিজেও বলছেন, “২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে যখন জোট হয়েছিল, তখন তো গোটা নদিয়ায় জোটের হয়ে একাই দায়িত্ব সামলেছি। তা ছাড়া, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সব সময়ই ছিল। তৃণমূলের সঙ্গে হঠাত্ করে যোগাযোগ হয়েছে, এমনটা আমার ক্ষেত্রে বলা যাবে না।”
তবুও তাঁর তৃণমূলে যাওয়া নিয়ে শান্তিপুরের মনে হাজারো প্রশ্ন। সেই সব প্রশ্নের ভরসাতেই ময়দানে নেমেছে কংগ্রেস এবং সিপিএম।
শান্তিপুর পুরসভার ২১টি ওয়ার্ড তৃণমূলের দখলে। পুরসভায় এখন একমাত্র কংগ্রেস প্রতিনিধি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কুমারেশ চক্রবর্তী। একদা অজয়বাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সেই কুমারেশই এ বার উপ-নির্বাচনে কংগ্রেসের টিকিটে লড়ছেন। সিপিএমের প্রার্থী শান্তিপুর পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি অনুপ ঘোষ।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কুমারেশবাবুর বিশ্বাস, “এখানে মানুষ কংগ্রেসকে ভালবেসে ভোট দেন। এ বারেও দেবেন।” কিন্তু শান্তিপুরের মানুষ তো কংগ্রেস বলতে অজয়বাবুকে দেখেই ভোট দিতেন? তিনি তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ালে ভোট পাবেন না কেন? গলার স্বর বদলে যায় কুমারেশের। বলেন, “১৯৮৪ সালে যখন অজয়বাবুর দাদা অসমঞ্জ দে খুন হওয়ার পর থেকে শান্তিপুর কংগ্রেসকে ফেরায়নি। অথচ, অজয়বাবু বিশ্বাসঘাতকতা করে দল বদলে ফেললেন। শান্তিপুরের মানুষ কিছুতেই তা মানতে পারছেন না।”
অজয়বাবু তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে নদিয়া জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুমারেশবাবু শান্তিপুরের পাঁচ বারের বিধায়কের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি এলাকায় বিলি করেন। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে শান্তিপুরে বৈদ্যুতিক চুল্লি, গঙ্গার জল পরিশোধন করে পানীয় জল সরবরাহ-সহ যে সব প্রকল্পকে অজয়বাবু নিজের সাফল্য বলে প্রচার করেছেন এত দিন, সে সব কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের টাকায় হয়েছে। কোন যুক্তিতে শান্তিপুরের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস ভবনের নাম পাল্টে রাতারাতি তৃণমূল ভবন করা হয়েছে, সে প্রশ্নও আছে চিঠিতে।
সিপিএমের অনুপ ঘোষের অভিযোগ, “শুধু শহরটুকু নিয়ে তো আর শান্তিপুর নয়। গ্রামাঞ্চলে তাঁত-শ্রমিক থেকে কৃষিজীবীসর্বস্তরের মানুষের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে দল পাল্টেছেন অজয়বাবু। এখন শাসক দলের আশ্রয়ে সন্ত্রাস করছেন।”
অজয়বাবু অবশ্য দাবি করেছেন, কংগ্রেসের ঐতিহ্যবাহী ভবনের এখন আর অস্তিত্ব নেই। অন্য একটি বাড়িতে তিনি তৃণমূল ভবন গড়েছেন। এলাকায় উন্নয়নের কাজ করেছেন বিধায়ক তহবিল এবং পুরসভার প্রাপ্য টাকায়। তাঁর পাল্টা আক্রমণ, “এ বারের কংগ্রেস প্রার্থী আগে বিজেপি, সিপিএমেও ঘুরেছেন। উনি আগে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন। আর গ্রামীণ এলাকায় মানুষ ক্ষুব্ধ বলে বামেদের অপপ্রচারে জনতা কান দেবে না। তারা জানে আড়াই দশকে শান্তিপুর কী থেকে কী হয়েছে।”
তবে স্থানীয় তৃণমূলের একটা বড় অংশের অজয়বাবুকে মেনে নিতে যে বেশ অসুবিধা হচ্ছে, সে কথাও শোনা যাচ্ছে দলের অন্দরে। তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে অজয়বাবু দলের শহর সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেন কংগ্রেস ছেড়ে আসা আর এক নেতা অশোক ঘোষকে। তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূলের একাংশের। যদিও অশোকবাবু এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
এই পরিস্থিতিতে অজয়বাবুকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তাঁর সমর্থনে স্থানীয় বিদ্বজ্জনেরা লিফলেট বিলি করেছেন। সেই দলে চিকিত্সক, আইনজীবী, নাট্যকর্মীরা রয়েছেন। গত আড়াই দশকে শান্তিপুরের জন্য ‘এত কিছু করা’ নেতাকে লিফলেট ছড়াতে হচ্ছে কেন? লড়াইটা কি তা হলে কংগ্রেসের অজয় বনাম তৃণমূলের অজয়ের? ম্লান হাসলেন তৃণমূল প্রার্থী। সেই হাসিতে যেন ইঙ্গিত, গত আড়াই দশকের শান্তিপুরের বিধায়ক আর পুরপ্রধান তাঁর পিছু ছাড়ছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy