Advertisement
০৪ মে ২০২৪

পায়ে বল নিয়ে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ

মনখারাপ ভুলিয়ে দিতে করিমপুর সীমান্তের একটি হোমের ছেলেদের ফুটবল খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় এক রেফারি। ডোমকলের পাশাপাশি দুই গ্রামের অহি-নকুল সম্পর্ক গলায়-গলায় করে দেওয়া কিংবা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেওয়ার মতো একাধিক বার অন্য ভূমিকা নিয়েছে ফুটবল। কিন্তু সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ফুটবল? নাঃ, স্মৃতি হাতড়েও এমন ঘটনার কথা মনে করতে পারছেন না ডোমকলের বহু প্রবীণ।

চলছে ফুটবল। বিশ্বজিত্‌ রাউতের তোলা ছবি।

চলছে ফুটবল। বিশ্বজিত্‌ রাউতের তোলা ছবি।

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৭
Share: Save:

মনখারাপ ভুলিয়ে দিতে করিমপুর সীমান্তের একটি হোমের ছেলেদের ফুটবল খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় এক রেফারি। ডোমকলের পাশাপাশি দুই গ্রামের অহি-নকুল সম্পর্ক গলায়-গলায় করে দেওয়া কিংবা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেওয়ার মতো একাধিক বার অন্য ভূমিকা নিয়েছে ফুটবল। কিন্তু সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ফুটবল? নাঃ, স্মৃতি হাতড়েও এমন ঘটনার কথা মনে করতে পারছেন না ডোমকলের বহু প্রবীণ।

“পারবেন কী করে? এমন ভাবনাটাই যে আগে কারও মাথায় আসেনি।” হাসতে হাসতে বলছেন ডোমকলের কুশাবেড়িয়া যুব সঙ্ঘ পাঠাগারের সহ সম্পাদক অহিদুল ইসলাম। সোমবার কুশাবাড়িয়া হাই স্কুল ফুটবল ময়দানে আয়োজন করা হয়েছিল একদিনের নক আউট ফুটবল প্রতিযোগিতা। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের মোট চারটি দল ওই প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিল। ফাইনালে কুশাবাড়িয়া ফুটবল দল নদিয়ার কুলগাছি শরত্‌ নজরুল স্মৃতি সঙ্ঘকে ২-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়।

ডোমকলে লিগের খেলা হোক কিংবা একদিনের নকআউট, ফুটবলের নাম শুনলেই দর্শকের ভিড়ে উপচে পড়ে প্রত্যন্ত এই এলাকার ফুটবল মাঠ। তবে এই খেলায় দর্শকের উপস্থিতি যেন আগের সব রেকর্ডকেই ভেঙে দিল। প্রতিযোগিতার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই মাইকে ও লিফলেট বিলি করে প্রচার করা হয়েছিল। আর সেই লিফলেট কিংবা মাইকে ঘোষণাও ছিল অভিনব। হলুদ রঙের লিফলেটে কালো কালি দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা ছিল--- সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ফুটবল প্রতিযোগিতা।

ডোমকলের এক বাসিন্দা রজব আলি বলছেন, “নানা ঘটনা উপলক্ষে সীমান্তের এই এলাকায় ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ফুটবল এর আগে কখনও হয়েছে বলে তো মনে করতে পারছি না। তাই যেদিন থেকে ওই ঘোষণার কথা শুনেছিলাম সেদিন থেকেই ঠিক করে পেলেছিলাম ওই খেলা দেখতে যেতেই হবে। কারণ এই খেলাতে উপস্থিতি থাকাটাও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।”

হঠাত্‌ এ রকম উদ্যোগ কেন? একসঙ্গে হইহই করে ওঠেন কুশাবেড়িয়া যুব সঙ্ঘের সদস্যরা, “হঠাত্‌ বলছেন কেন? চারদিকে যা চলছে, তার একটা প্রতিবাদ করার খুব দরকার ছিল। কেউ প্রতিবাদ জানানোর জন্য বেছে নেন মিটিং, মিছিল, সভা, কেউ আবার মঞ্চ বেঁধে গান-বাজনাও করেন। কিন্তু আমরা বেছে নিয়েছিলাম ফুটবলকেই।” তার কারণটাও অবশ্য সাফ জানাচ্ছেন ওই সদস্যেরা। তাঁদের কথায়, “ফুটবলের মাধ্যমে যত বেশি লোকজনকে একজায়গায় আনা সম্ভব তা অন্য কোনও মাধ্যমে সম্ভব নয়। আর ডোমকলের মানুষের ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার কথা জানেন গোটা জেলার মানুষ। সেই কারণেই ফুটবলকেই আমরা বেছে নিয়েছিলাম।”

খেলার মাঠে প্রশাসনের কর্তাদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় কুশাবাড়িয়া জুম্মা মসজিদের ইমাম মেহেরুল ইসলাম বিশ্বাস। তিনি বলেন, “যারা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু তাদের কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। ইসলাম সবসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তাই গ্রামের ছেলেরা সেই সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে যে ভাবে ফুটবলকে বেছে নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা চাইছি এলাকার অন্য ক্লাবগুলোও এমন আয়োজন করুক। তাহলে সমাজের সর্বস্তরেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া যাবে।” ডোমকলের মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দু মিত্র, এসডিপিও অরিজিত্‌ সিংহ জানান, এই অভিনব আয়োজনে কুশাবাড়িয়া কিন্তু গোটা জেলাকে পথ দেখাল।

তবে সীমান্তের এই এলাকায় ফুটবল যে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে তা এখন প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন প্রশাসনের কর্তারা। বেশ কয়েক বছর আগেও ডোমকলের বিভিন্ন এলাকায় বোমাবাজি, খুন, জখম ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। অথচ গত কয়েক বছরে সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনে যে ফুটবলের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে তা-ও স্বীকার করেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুবলের এমন আয়োজন শুনে প্রথমে কিন্তু চমকে উঠেছিলেন তাঁরাও। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, “ফুটবল নিয়ে যে কী কী হতে পারে তা ডোমকলকে না দেখলে জানা যেত না।”

করিমপুর থেকে খেলা পরিচালনা করতে এসে সুজিত বিশ্বাস বলছিলেন, “বছর কয়েক আগে করিমপুর হোমের কয়েকজন কিশোরকে করিমপুর রেগুলেটেড মার্কেটের মাঠে মনখারাপ করে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সেদিনই ওদের ফুটবল খেলার পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলাম। এখন ওরা দাপিয়ে লিগের খেলা খেলছে। তবে কুশাবেড়িয়ায় খেলা পরিচালনা করতে এসে যে ভাবে ফুটবল পায়ে সন্ত্রাসের প্রতিবাদে সামিল হলাম তা সারাজীবন মনে রাখব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE