পাথুরে বাঁধনে বছর কয়েক শান্ত থাকার পর নদীর জলে আবার মাটির খিদে। পাক খেতে খেতে নদী ধাক্কা মারছে পাড়ে। সেখানে শুকনো মাটি ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে জলে। এই সব বিপজ্জনক সঙ্কেত খুবই চেনা স্থানীয় মৎস্যজীবি এবং নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ওঁরা জানেন এসবই নদী ভাঙনের পূর্ব লক্ষণ। প্রায় পাঁচ বছর পর আবার ভাঙনের অশনি সঙ্কেত নজরে আসছে নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরে।
শীতের শুখা মরসুম জুড়ে গঙ্গার জলস্তর একটু একটু করে নামতেই নবদ্বীপ পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাচীন মায়াপুরের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম সংলগ্ন নদীর পাড়ের মাটি আলগা হয়ে খসে পড়া শুরু হয়েছে। পাড় থেকে একটু ভিতরে নদীর জল বড় ব্যাসার্ধে জোরালো ভাবে পাক খাচ্ছে ক্রমাগত। লক্ষ্মণ দেখে চৈতন্য জন্মস্থান, ভূমাসুখ আশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, নরহরি ধাম, মৌনীবাবা আশ্রম-সহ প্রাচীন মায়াপুরের বিভিন্ন মন্দির প্রধানদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলে জানিয়েছেন। বিপদ বুঝে জেলা সেচ দফতর জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। জেলা সেচ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে প্রাথমিক ভাবে বাঁশের খাঁচা করে নদীর পার বরাবর বোল্ডার ফেলা হচ্ছে। এজন্য আপাতত সাড়ে সাত লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
নবদ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে ভাঙনের সম্পর্ক সেই সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গঙ্গার গতিপথ বদল এবং নদীর ভাঙনের ফলে নবদ্বীপের মানচিত্র বদলে গিয়েছে। আশির দশক থেকে নতুন ভাবে নবদ্বীপে উত্তর এবং পূর্ব দিকে গঙ্গার ভাঙন শুরু হয়। তলিয়ে যায় একরের পর একর জমি, বসত বাড়ি, স্কুল, চিনির মিল, প্রাচীন মন্দির, পুরসভার রাস্তা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহরের উত্তরসীমায় অবস্থিত প্রাচীন মায়াপুর। দফায়-দফায় গঙ্গার ভাঙনে নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে চৈতন্যধামের বেশ কিছুটা অংশ। নদীর আগ্রাসন থেকে নবদ্বীপকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময়ে উপ-রাষ্ট্রপতি থেকে রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী থেকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী পরিদর্শন করে গিয়েছেন। বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা হয়েছে নদীকে শান্ত করতে। কিন্তু সাময়িক ভাবে ভাঙন ঠেকানো গেলেও স্থায়ী সাফল্য মেলেনি।
তবে শেষ বড় ভাঙন হয়েছিল সেই ২০০৪ সালে।
সম্প্রতি ফের নদীর চরিত্রে পরিবর্তন চোখে পড়ছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় পুরপিতা সুকুমার রাজবংশী বলেন, “আমি নিজেও জন্ম থেকে নদীর পাড়ে থাকি। ফলে এই ধরনের পরিবর্তন খুব সহজেই ধরতে পারি। সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা এসে অবস্থা দেখেই কাজ শুরু করেছেন। এরপরেই বর্ষার মরসুম। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা না নিলে পরে বড় সমস্যা হতে পারে।”
নদিয়া জেলা সেচ দফতরের এসডিও সুবীর রায় বলেন, “এখানে নদীর জল অনেকটা জায়গা নিয়ে চক্রের মতো পাক খাচ্ছে। ফলে পাড়ের মাটি নীচের দিকটা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আলগা হয়ে খসে পড়ছে ধীরে-ধীরে। বৃষ্টি নামলে পাড় ধসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এখনই এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।’’
সুবীরবাবু জানান, পাঁচ বছর আগে এই এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে নদীর বুকে চারটি ‘স্পার’ তৈরি করা হয়েছিল এবং নদীর পাড় বোল্ডার দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই স্পার জলের পাক থামিয়ে দিয়েছিল সেই সময়। এই ক’বছরে স্পার চারটে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আপাতত বাঁশের খাঁচা করে বোল্ডার দিয়ে স্পার মতো তৈরি করে পরীক্ষামূলক ভাবে জলে ফেলা হচ্ছে। এতে কাজ হলে বড় আকারে স্পার তৈরি করা হবে।
আশার কথা শুরুতেই নড়েচড়ে বসেছে জেলা সেচ দফতর। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার অপেক্ষায় না থেকে কাজ চলছে জোরকদমে।