ডোমকলের মাঠে বিদেশি ফুটবলারের দৌড়। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।
‘লেটস ফুটবল’-এর ঢেউ লেগেছে প্রত্যন্ত এলাকাতেও। শীত নামতে না নামতেই এতদিন যেখানে মাঠ দখল করত ব্যাট-বল, সেখানে এই বছর মাঠে মাঠে চলছে ফুটবল প্রতিযোগিতা। মানুষও ভিড় জমাচ্ছে মাঠে। আর এ সব খেলার মূল আকর্ষণ হয়ে উঠছেন দীর্ঘকায়, কৃষ্ণবর্ণ, ঝাঁকড়া চুলের নাইজেরিয়ান ফুটবলাররা। না, তাঁরা সকলেই যে দারুণ ফুটবল খেলে পাড়া মাত করে দিচ্ছেন তা একেবারেই নয়। বরং মাঠে এসে হতাশ হচ্ছেন ফুটবল-বোদ্ধা অনেক দর্শকই। তবু সাধারণ দর্শকের চাহিদা মেনে ক্লাবগুলিও ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদেশি খেলোয়াড় ‘দেখানো’র হুজুগে।
১৫ নভেম্বর বসন্তপুর মাঠে বসন্তপুর এডুকেশন সোসাইটির পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হল একটি নক-আউট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা। পরদিন রবিবার কুশাবাড়িয়া ফুটবল মাঠে কুশাবাড়িয়া আজাদ ক্লাবের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হল নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের মোট চারটি দল নিয়ে একদিনের ফুটবল। প্রায় সব ক’টি ক্লাবেই ছিল নাইজেরিয়ান খেলোয়াড়। তাই খেলাকে ঘিরে উত্তেজনাও ছিল চরমে। কুশাবাড়িয়া আজাদ ক্লাবের কর্মকর্তা তজিমুদ্দিন খাঁন বলেন, “এই মরসুমেও ফুটবল নিয়ে মানুষের এত উন্মাদনা এই প্রথম দেখলাম। মাঠ থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ফুটবলের মরা গাঙে যে ভাবে জোয়ার এসেছে সেটা ধরে রাখতে পারলে সত্যিই ফুটবলের উন্নতি সম্ভব। বিদেশি খেলোয়াড়দের খেলা দেখে আমাদের এলাকার ছেলেরা যদি ভাল খেলা শিখতে পারে তবে তার থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না।”
কিন্তু সংশয় একটা থেকেই যাচ্ছে ক্লাব কর্তাদের মধ্যেও। একদিকে যেমন খেলাকে ঘিরে আছে উন্মাদনা, তেমনি বিদেশি খেলোয়াড় খেলানো নামে চলছে মুড়ি মুড়কির মতো খরচ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্ন মানের খেলোয়াড় এনে চলছে ‘শো-অফ’। ঢাকের দায়ে কোথাও কোথাও মনসা বিক্রির দশা। দলগুলি পুরস্কার বাবদ যে অর্থ পাচ্ছে তার দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে বিদেশি খেলোয়াড়দের পিছনে। অন্যদিকে স্থানীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটা বিরাট ফারাক তৈরি হচ্ছে। তার ফলে স্থানীয় খেলোয়াড়দের উন্নতির বদলে অবনতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কুশাবাড়িয়ার প্রবীণ খেলোয়াড় ওহিদুল ইসলাম বলেন, “চলতি বছরে বিদেশিরা তিন হাজারের বেশি টাকা চাইছে ম্যাচ প্রতি। এমনকী দর্শকদের চাহিদা মেনে অনেক ক্লাবই বাধ্য হচ্ছে খেলার মানের সঙ্গে আপোশ করে নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় রাখতে। এতে স্থানীয় যুবকদের সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে।”
দলগুলি চ্যাম্পিয়ন হিসাবে কোথাও পাচ্ছে কুড়ি হাজার আবার কোথাও পনেরো হাজার। রানার্সের ঝুলিতে থাকছে পনেরো থেকে দশ হাজার। অথচ দল গড়তে ক্লাবগুলি ঝাপিয়ে পড়ছে বড় বাজেটে। তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজারের বাজেটে দল গড়ছে এক একটা গ্রাম। বিশেষ করে বিদেশি খেলয়াড়দের আনতে গিয়ে বড় অঙ্কের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে ক্লাবগুলিকে।
রবিবার কুশাবাড়িয়া মাঠের চ্যাম্পিয়ন দল কুশাবাড়িয়া পেয়েছে ২০ হাজার টাকা। ওই দল গড়তে কিন্তু খরচ হয়েছে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। কর্তাদের দাবি, গ্রামের আবেগ মেটাতে গিয়ে বাজেট বাড়ছে। তাছাড়া ফুটবলের জন্য মানুষও এগিয়ে আসছে। ফলে কষ্ট হলেও খেলা হয়ে যাচ্ছে।
বসন্তপুর এডুকেশন সোসাইটির ফুটবল দলের সদস্য মানারুল হোসেন বলেন, ‘‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পেয়েছি ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু দল গড়তে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। বাকি অর্থ গ্রামের মানুষ ও সোসাইটির পক্ষ থেকে সাহায্য পেয়েছি। না হলে ভাল দল গড়া সম্ভব হত না।’’
বিদেশি ফুটবলার খেলানোর অন্যদিকও রয়েছে। ডোমকল আজাদ ক্লাবের খেলোয়াড় হাসিবুল ইসলাম বাবু বলেন, “আমরা ম্যাচ প্রতি ৫০০-৭০০ টাকা পাচ্ছি। সেখানে এক নাইজেরিয়ান ২০০০-২৫০০ পাচ্ছে। একটা বিরাট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের খেলার প্রতি অনিহাও তৈরি হচ্ছে। বিদেশি খেলোয়াড়ের সঙ্গে পরস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে। ফলে খেলার উপরও তার প্রভাব পড়ছে।” কুশাবাড়িয়া মাঠে খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নদিয়ার সুজিত বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামের দলগুলি প্রচুর অর্থ খরচ করে নিচু মানের নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় তুলে আনছে। ফলে এই টুর্নামেন্টগুলিতে নাইজেরিয়ান দেখে মানুষের উন্মাদনা থাকলেও শেষে তারা হতাশ হচ্ছেন। ক্লাব কর্মকর্তাদের বিষয়টির উপরে নজর দেওয়া উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy