Advertisement
১৭ মে ২০২৪

বিধি বাম মান্নানের

সবে প্রথম রাউন্ড গণনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের শুরু। হন্তদন্ত হয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন মুর্শিদাবাজের কংগ্রেস প্রার্থী, দু’বারের জয়ী সাংসদ মান্নান হোসেন। মাথাট নিচু, মুখ ভার। ‘মিডিয়া সেন্টারে’ এসে একটা চেয়ার টেনে বসলেন তিনি।

জেতার পরে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান।  ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।

জেতার পরে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।

সুজাউদ্দিন
লালবাগ শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০০:৫২
Share: Save:

সবে প্রথম রাউন্ড গণনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের শুরু। হন্তদন্ত হয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন মুর্শিদাবাজের কংগ্রেস প্রার্থী, দু’বারের জয়ী সাংসদ মান্নান হোসেন। মাথাট নিচু, মুখ ভার। ‘মিডিয়া সেন্টারে’ এসে একটা চেয়ার টেনে বসলেন তিনি। পায়া টানার আওয়াজে মিশে গেল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। হয়তো দিনের শুরু দেখেই শেষটা বুঝে গিয়েছিলেন। অনুমানে ভুল হয়নি পোড় খাওয়া এই রাজনীতিবিদের। সিপিএম প্রার্থী বদরুদ্দোজা খান ২০,৪৫৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিলেন তাঁকে। তবে, একটি ইভিএম খারাপ থাকায় রাত পর্যন্ত ফল ঘোষণা হয়নি এই কেন্দ্রের।

শুক্রবার কড়া পাহারার মধ্যে লালবাগ সুভাষচন্দ্র সেন্টিনারি কলেজে গণনা শুরু হয়। দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর কংগ্রেস কর্মী এসে জড়ো হয়েছিলেন। সেই তুলনায় তৃণমূল বা সিপিএমের লোক ছিল কম। বেলা যত গড়ায়, মান্নান হোসেনের জেতার সম্ভাবনা ততই ক্ষীয়মান হয়ে আসে। বাইরে কংগ্রেস কর্মীদের ভিড়ও পাতলা হতে থাকে ক্রমশ। ১০ রাউন্ড গণনার পর বিকেল ৪টে নাগাদ সস্ত্রীক গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান মান্নান হোসেন। পিছু-পিছু এক-দু’জন করে চলে যান দলের প্রায় সকলেই। যাওয়ার সময় ডোমকলের এক কংগ্রেস কর্মী গজগজ করতে করতে বলেন, “আমাদের বিধানসভা কেন্দ্রে এত ভাল লিড দিয়েছিলাম। তারপরেও হেরে গেলাম। খাটাখাটি সব বৃথা।”

কর্মীদের ‘খাটাখাটি’ অবশ্য যথেষ্ট হয়নি বলেই মনে করছেন কংগ্রেস প্রার্থী। গণনা চলাকালীন দলীয় কর্মীদের এই নিয়ে বকাবকিও করেছেন তিনি। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন কর্মীকে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘লিড’ দেওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তাঁরা, মিলল না কেন? জবাবে মুখে তর্ক করেননি কর্মীরা। তবে, আড়ালে নিজেদের মধ্যে প্রার্থীর ‘খাটাখাটি’ নিয়ে অনুযোগ করতে ছাড়েননি তাঁরা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এ বার মান্নান হোসেন সেই ভাবে প্রচার করতে পারেননি। শুধু সেই দিকে নয়, গত পাঁচ বছরে এলাকায় জনসংযোগেও সাংসদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছিল বলে মনে করছেন ওই কর্মীরা।

এই প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদে সিপিএমের এই জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না বলেই জানাচ্ছে রাজনৈতিক মহল। গত বিধানসভা ভোটের হিসেবে এই লোকসভা কেন্দ্রে এগিয়ে বামেরা। সাতটির মধ্যে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে তাদের দখলে। এরপর পঞ্চায়েত ভোটের হিসাবেও এই লোকসভা কেন্দ্রে এগিয়ে গিয়েছে বামেরা। ফলে রাজনীতির সাদা হিসাবে বামেদের এগিয়ে থাকারই কথা ছিল। তারপরেও লোকে কংগ্রেসের সম্ভাবনা দেখছিল, শুধু মান্নান সাহেবের ব্যক্তিগত ‘কারিশমা’র কথা মাথায় রেখে।

দু’দলের ভোট কাটাকাটিতে তৃণমূল প্রার্থী মহম্মদ আলি জিতে বেরিয়ে যেতে পারেন, এমনটাও ভেবেছিলেন কেউ কেউ। সেই অনুমান না মিললেও এটা ঠিক, তৃণমূলের জন্যই কংগ্রেসের এতটা খারাপ অবস্থা মুর্শিদাবাদে। গত কয়েক বছরে কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে কংগ্রেসের সাংগঠনিক ভিত দুর্বল হয়েছে ক্রমশ। এ দিন মান্নান হোসেন হারের কারণ ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “তৃণমূল আমাদের ভোটটা কেটে নিয়েছে। বিজেপিও প্রায় এক লক্ষ ভোট পেয়েছে। সেটা আমাদের থেকেই গিয়েছে বলে মনে করছি।”

সেখানে বামেরা জেতার কারণ হিসাবে বারবার সাংগঠনিক শক্তিরই জয়গান গাইছেন। আর জয়গান আনিসুর রহমানের। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বামজমানার এই মন্ত্রী এ বার হয়তো ছোটাছুটি করেননি বিশেষ। কিন্তু এলাকায় থেকে একের পর এক কর্মিসভা করেছেন, কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। প্রার্থী বদরুদ্দোজা খানের কথায়, “ওঁর সঙ্গে এমনও জায়গায় গিয়েছি, যেখানে একা যাওয়ার সাহস করতে পারতাম না। মার খেয়ে যেতাম।”

বদরুদ্দোজার নিজেরও যথেষ্ট কৃতিত্ব আছে জয়ের পিছনে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই শিক্ষক-প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণের কোনও জায়গা ছিল না। এ দিন গণনার শেষ পর্যন্ত বসে ছিলেন বদরুদ্দোজা। সঙ্গে কিছু কর্মী। তবে জয়ের উচ্ছ্বাসটা তেমন ছিল না। কিছুটা মনমরা ভাবেই বদরুদ্দোজা বলেন, “রাজ্যের অন্য জায়গার মতো এখানে রিগিং হয়নি। সেই জন্যই এখানে আমরা জিততে পেরেছি। রাজ্যের অন্যত্র সন্ত্রাসের কারণে মানুষ আমাদের ভোট দিতে পারেনি। তা হলে এই হাল হত না।”

বামফ্রন্টের হতাশার ছায়ায় ম্লান দেখায় বিজয়ীকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sujauddin lalbagh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE