মহরমে দুলদুলকে শ্রদ্ধা খুদের। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
মাতম্— শোকের পরব মহরম। গোটা মহরম মাস জুড়ে সেই শোক পালন। ঐতিহাসিক মিশে আছে আত্মত্যাগের শপথ।
মাতম্,— তার কত রকমফের! আগুন-মাতম্ গনগনে কাঠকয়লার আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে চলা। জঞ্জির (লোহার শিকল)-মাতম্। শিকলের সামনে-পিছনে ছোরা। হাত-মাতম্ (বুক চাপড়ানো)প্রতি বছর মহরম মাসের এই শোক তো ঐতিহাসিক। সকলেই শোকপালন করেন এবং শোকপালনের পদ্ধতি! এভাবেই। শোকপালন চলে গোটা মহরম মাস ভর।
এ দিকে মহরম উপলক্ষে ১০ দিনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে হাজারদুয়ারি সংলগ্ন ইমামবাড়া। রবিবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ হাত-মাতম্ করতে করতে সারিবদ্ধ ভাবে মিছিল করে আসেন। হোসেনের মৃত্যু, তাই শোকমিছিল। উদ্দেশ্য, ইমামবাড়া। এদিন সকালে লালবাগের দারাবলী খাঁ এস্টেট থেকে মিছিল করে প্রায় হাজার খানেক সববয়সী মানুষ মিছিল করে এসে ইমামবাড়ায় সমবেত ভাবে হাত-মাতম্ করেন। সঙ্গে জারি গান। সকলেই সাদা ও কালো রংয়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত। বেলা বাড়তেই হাত-মাতম্-এর গতির সঙ্গে সঙ্গে শব্দও বাড়তে থাকে। তাঁরা বুক চাপড়ে প্রয়াত হোসেনের প্রতি সমবেদনায় শোকজ্ঞাপন করছেন। বাদ যাননি মহিলারাও। কালো বোরখার আড়ালে তাঁরাও একাত্মচিত্মে বুক চাপড়াচ্ছেন।
মহরমের শোকে ভাসছে মুর্শিদাবাদ। এক হাজার তিনশো ছাব্বিশ বছরের ঐতিহাসিক ঘটনার শোক বারেবারে ফিরে আসে মুসলিম জন চিত্তে। হাজার হাজার মাইল দূরত্ব পেরিয়ে, কারবেলার ঘটনায় হাসান-হোসেনের মৃত্যুতে শোক পালনের রীতি প্রাচীন এবং তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে হাজারদুয়ারি সংলগ্ন ইমামবাড়াতে। অন্তত কয়েকশো মানুষ বুক চাপড়ে শোকপ্রকাশ করেন। ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ রব ওঠে। সাক্ষী পর্যটন মরশুমে হাজারদুয়ারি ঘুরতে আসা পর্যটকরা। মাতম্ দেখতে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের সববয়সী নারী-পুরুষ দলে দলে ছুটে এসেছেন।
আজ সোমবার রাতে হবে আগুন-মাতম। চলবে রাতভর। শিয়া সম্প্রদায় দু-মাস আট দিন ধরে শোক উত্সব পালন করেন। চল্লিশ দিনের অনুষ্ঠানকে চল্লিশা, দু-মাসের মাথায় ষাটা ও শেষ দিন ‘আশাগারিয়া’ পালনের মধ্যে দিয়ে ওই শোক উত্সব সম্পন্ন হয় বলে জানালেন সিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা মেহেদি আলম মির্জা। তিনি বলেন, “গত ১০ দিন ধরে শোকপালন চলছে। শোকপালনের মধ্যে তেল ও সাবান ব্যবহার করা যায় না। মাছ-মাংস খাওয়াও নিষেধ। নিরামিষ রান্না খেতে হয়। শোক-পালনের পাশাপাশি অনেকে মহরম উপলক্ষে রোজা রাখেন। বিশেষ নমাজ পাঠও করেন অনেকে। দান-খয়রাত করেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বাড়িতে বাড়িতে রাত জেগে বিভিন্ন ধরণের হালুয়া, চালের রুটি তৈরির পাশাপাশি গরীব-দুঃখী মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য রান্না হয় পোলাও।”
মহরমকে সামনে রেখে লালবাগ-সহ মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকার মুসলিম মহল্লাগুলি নতুন সাজে সেজেছে। রঙিন কাগজের শিকল তৈরি করে মহল্লা সাজানো হয়েছে। মহল্লা সাফ-সুতরো রাখার কাজে ব্যস্ততা রয়েছে পাড়ার উঠতি যুবকদের মধ্যেও। লালবাগ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “গত ২৫ অক্টোবর থেকে হাজারদুয়ারি চত্বরে মহরম উপলক্ষে মেলা বসেছে। মহরম উপলক্ষে এই সময়ে প্রতি বছরই মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারি দেখতেও পর্যটকদের ভিড় থাকে। তাদের কাছে মহরমের উত্সব বাড়তি আকর্ষণ। প্রতি বছরই ওই পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে, এটা আশার কথা।” তবে সপরিবারের কলকাতার লেকটাউন থেকে বেড়াতে আসা শ্রাবণী বসু বলেন, “ঐতিহাসিক হাজারদুয়ারি প্রাঙ্গনে অপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন অস্থায়ী দোকান খুলে বসেছে। ফলে মিউজিয়াম চত্বর জুড়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব ভীষণ ভাবে অনুভূত হল। এ ব্যাপারে প্রশাসনের ভাবনা-চিন্তার অভাব রয়েছে বলেও মনে হল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy