Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মেলা রথের ভিড়ে রথের মেলা নবদ্বীপে

বঙ্কিমের রাধারানি পথ হারিয়েছিল মাহেশের রথের মেলায়। আর মেলা রথের ভিড়ে পর্যটক দিশা হারাতে পারেন নবদ্বীপে। রথের দিন গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে হাজার বছরের এই প্রাচীন জনপদের পথে-পথে রথের ভিড়। সময়ের রথে চড়ে এদের কেউ পেরিয়ে এসেছে তিনশো, দুশো বা শতবর্ষের সুদীর্ঘ পথ। কোনও রথ সেকালের কোনও জমিদার বাড়ির উদ্যোগে চালু হয়েছিল। কোনও রথের প্রচলন করেন ভিন্ রাজ্যের রাজকন্যা, কোনও রথ যাত্রা শুরু করেছিল সাধু বা বৈষ্ণবের হাত ধরে, কোনও রথ আবার ওপার বাংলায় যাত্রা শুরু করে নানা পট পরিবর্তনের ফলে চৈতন্যধামে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০০:৪৮
Share: Save:

বঙ্কিমের রাধারানি পথ হারিয়েছিল মাহেশের রথের মেলায়। আর মেলা রথের ভিড়ে পর্যটক দিশা হারাতে পারেন নবদ্বীপে। রথের দিন গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে হাজার বছরের এই প্রাচীন জনপদের পথে-পথে রথের ভিড়। সময়ের রথে চড়ে এদের কেউ পেরিয়ে এসেছে তিনশো, দুশো বা শতবর্ষের সুদীর্ঘ পথ। কোনও রথ সেকালের কোনও জমিদার বাড়ির উদ্যোগে চালু হয়েছিল। কোনও রথের প্রচলন করেন ভিন্ রাজ্যের রাজকন্যা, কোনও রথ যাত্রা শুরু করেছিল সাধু বা বৈষ্ণবের হাত ধরে, কোনও রথ আবার ওপার বাংলায় যাত্রা শুরু করে নানা পট পরিবর্তনের ফলে চৈতন্যধামে। জগন্নাথ বাড়ির বালক সাধুর রথ, মণিপুর রাজকন্যা পরম বৈষ্ণব বিম্বাবতি মঞ্জরীদেবীর ইচ্ছায় মণিপুর রাজবাড়ির রথ, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের রথ, সারদেশ্বরী আশ্রমের সন্ন্যাসিনীদের রথ--তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। কালের নিয়মে এর মধ্যে থমকে গিয়েছে একাধিক রথের চাকা। কোনও রথের চাকার থেমে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে থেমে যাওয়া প্রাচীন রথ আবার চলতে শুরু করেছে, এমন নজিরও রয়েছে।

সোয়া’শ বছর আগে চট্টগ্রামে সূচনা হয়েছিল মহাত্মা শচীনন্দনের রথযাত্রা। পরে সেই রথ চলে আসে নবদ্বীপে। তাঁর মৃত্যুর পর থেমে গিয়েছিল সেই রথ। বছর পাঁচেক হল প্রাচীন মায়াপুরের গিরিধারি আশ্রম থেকে আবার বের হছে সেই রথ।

মণিপুর রাজবাড়ির রথের চাকা নবদ্বীপের পথে গড়াচ্ছে প্রায় তিন শতাব্দী ধরে। মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ নবদ্বীপে আসেন ১৭৯৭ সালে। তাঁর কন্যা বিম্বাবতী মঞ্জরি মহাপ্রভু দর্শনের স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন। ১৮০৩ সালে ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর কুমার চৌরজি সিংহ বোন বিম্বাবতী মঞ্জরীর ইচ্ছানুসারে নবদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। তারপর ১৮০৫ থেকে নবদ্বীপে মণিপুর রাজবাড়ির রথের সূচনা। রাজবাড়ির চারটি মন্দির ঘুরে রথ ফিরে আসে রাজবাড়িতেই। মাসির বাড়ির প্রথা এখানে নেই। তবে উল্টোরথ পর্যন্ত এখানে প্রতি সন্ধ্যায় উৎসব হয়। মণিপুরী নাচের সঙ্গে জয়দেবের পদ গেয়ে জগন্নাথের সন্ধ্যারতি এই রথযাত্রাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষণ সেনের প্রধানমন্ত্রী হলায়ুধের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ হলেন জগন্নাথ গোস্বামী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ওপার বাংলার সুবিখ্যাত রথের চাকা থেমে গিয়েছে নবদ্বীপে এসে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাসুদেবের রথ নামে পরিচিত সেই রথের চাকা আর গড়ায় না। লোকাভাব আর অর্থাভাব এই দুইয়ের কাছে হেরে গিয়ে গতির উৎসব রথযাত্রার দিন বাসুদেব অঙ্গনে একা দাঁড়িয়ে থাকেন রথহীন বাসুদেব। প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে চৈতন্যপার্ষদ জগন্নাথ গোস্বামী ওই বাসুদেব মূর্তির সন্ধান পান। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার কাঠাদিয়া গ্রামে বাস করতেন জগন্নাথ গোস্বামী। কথিত আছে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এক পুকুর থেকে পেয়েছিলেন চার ফুট উচ্চতার কষ্টি পাথরের নিখুঁত বিগ্রহটি। সে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল নিকটবর্তী বর্ধিষ্ণু গ্রাম আড়িয়ালে। শুরুর সময় থেকেই রাজকীয় সমারোহে বাসুদেবের রথযাত্রা হত। তখন অবশ্য বিগ্রহের নাম ছিল যশোমাধব। অবিভক্ত বাংলাদেশে যশোমাধবের রথযাত্রার খ্যাতি ছিল সুবিদিত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগেই বিগ্রহ চলে আসে নবদ্বীপে। নাম হয় বাসুদেব। ১৯৪৫ থেকে ঢাকার বদলে নদিয়ায় চলেছে বাসুদেবের রথ। বাসুদেব অবশ্য কোনও দিনই রথে চড়েননি। তাঁর প্রতিনিধি হয়ে চড়তেন জগন্নাথদেব। কিন্তু সময় থামিয়ে দিয়েছে বাসুদেবের সেই রথ। সেবাইত পরিবারের কথায়, এদেশে আসার পর থেকেই আর্থিক সমস্যায় সেবাপুজোর অসুবিধা দেখা দেয়। তারপর আমাদের চোখের সামনেই কেমন একটু একটু করে থেমে গেল বাসুদেবের রথের চাকা। বহু জায়গায় দরবার করেছি। কিন্তু সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাসকে সচল রাখতে কেউ সাহায্য করেনি। তাই এখন রথের দিন নবদ্বীপ বউবাজারের বাসুদেব অঙ্গনে একা নিথর দাঁড়িয়ে থাকেন পাঁচশো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী রথহীন বাসুদেব।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই হারিয়েছে সীতানাথ বৈষ্ণব থোর। জরাজীর্ণ মন্দির। যখন তখন খসে পড়ছে চুন-বালির পলেস্তারা। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রাধারমণ জিউ মন্দিরের গা থেকে ইট কাঠ খুলে খণ্ডহরের চেহারা নিয়েছে। মন্দিরের সেবাইতরা জানান, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাওয়ার বছরেই জনৈক হরহর বাবাজি নবদ্বীপে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটা ১৭৫৭ সাল। থোর কথার অর্থ বিশ্রামাগার। এই হরহর দাস নিজে ছিলেন একজন বৈষ্ণব। সেই সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুব খারাপ। বাবাজির প্রধান কাজ ছিল নবদ্বীপে আসা বৈষ্ণব ভক্তদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা। গঙ্গার তীরে তিনি ভজন কুঠি গড়ে সে ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময়ের ঢাকার বিখ্যাত জাহাজ ব্যবসায়ী ঈশ্বরচন্দ্র মণ্ডল একবার নবদ্বীপের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার সময় বিশ্রাম নিতে হরহর দাসে আতিথ্য নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঈশ্বর তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরুর দেহান্ত ঘটলে তাঁর সমাধি মন্দির এবং গুরু পূজিত রাধারমণের বড় মন্দির গড়ে দেন। তবে এখানে জগন্নাথ দেবের আগমন কিছু পরে। মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রায় একশো বছর পরে পুরীর গোপীনাথ পান্ডা এই মন্দিরের সেবাইত নিযুক্ত হন। তিনি পুরীধাম ছেড়ে আসার সময় একটি জগন্নাথের মূর্তি সঙ্গে করে আনেন এবং সেটি প্রতিষ্ঠা করে পুরীর মন্দিরের অনুকরণে যাবতীয় সেবার ব্যবস্থা করেন। তাঁর আমল থেকেই রথযাত্রা চালু সীতানাথ বৈষ্ণব থোরে। সেটা ১৮৮৭ সাল।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সীতানাথ বৈষ্ণব থোর বিত্ত-বৈভব-যশ-প্রতিষ্ঠা সবই হারিয়েছে। বদলায়নি শুধু প্রথা। বলছিলেন মন্দিরের পাঁচপুরুষের জগন্নাথ সেবাইত বৃন্দাবন পান্ডা। পুরীর গম্ভীরা মঠে দীক্ষিত গোপিনাথ পান্ডা সব কিছুই করতেন পুরীর মতো করে। কিন্তু চরম অভাবের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করা বর্তমান সেবাইতদের তাতে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়। তাঁদের কথায়, “যতই অনটন থাকুক, প্রথা থেকে একচুল নড়ার উপায় নেই। স্নান যাত্রার দিন থেকে শুরু হয় রথের উৎসব। পরের দিন জগন্নাথের জ্বর হয়। পাঁচ দিন পরে বিশেষ পাঁচন খেয়ে সেই জ্বর ছাড়ে। ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় অঙ্গরাগ। এই অঙ্গরাগ চলাকালীন পরে অমাবস্যা। সেই দিন হয় বিগ্রহের নেত্র উৎসব বা চক্ষুদান। রথের দিন বিশেষ পুজো অভিষেক সেরে পথে নামেন প্রায় দেড়শো বছরের প্রাচীন জগন্নাথ। বৃন্দাবনবাবুদের আক্ষেপ, নবদ্বীপে ওড়িশার প্রচুর মানুষ থাকেন। তাঁরা সবাই এই রথের ইতিহাস জানেন। অথচ কেউ খবর নেন না কী ভাবে রথ চলেছে। আর কতদিন এই রথ চলবে তা নিজেরাও জানেন না বৃন্দাবনবাবুরা। তবে নড়বড়ে রথ আর ভক্তদের উপেক্ষা নিয়ে হয়তো এবারেও পথে নামবেন সীতানাথ বৈষ্ণব থোরের প্রভু জগন্নাথ। তবে আর কদিন তাঁর এই রথ চলবে তা কেবল তিনিই জানেন।

রথের দিন উত্তর থেকে দক্ষিণে কিংবা পূর্ব থেকে পশ্চিমের পথে পথে যখন একসঙ্গে সব রথ পথে নামে তখন সময়ও থমকে যায়। পথিক পথ হারিয়ে আপন মনে বিড় বিড় করে-- রথের মেলা, নাকি মেলা রথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nabadwip rath rath mela
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE