Advertisement
E-Paper

মনোরোগীদের বাড়ি ফেরানোয় বুঁদ মোসলেম

ভরা বাজারে বারবার দোকানে হামলে পড়ে খাবার চাইছিল ‘পাগল’টা। আর সেই ‘অপরাধে’ তাঁর হাতে গরম তেল ঢেলে দূর করে দিয়েছিলেন দোকানি। চোখের সামনে ঘটনাটি দেখে আর থাকতে পারেননি তিনি। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তিকে তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। দিনের পর দিন চিকিত্‌সকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে তোলেন বীরভূমের মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তিকে।

মনিরুল শেখ

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৪৬
মোসলেম মুন্সি। —নিজস্ব চিত্র

মোসলেম মুন্সি। —নিজস্ব চিত্র

ভরা বাজারে বারবার দোকানে হামলে পড়ে খাবার চাইছিল ‘পাগল’টা। আর সেই ‘অপরাধে’ তাঁর হাতে গরম তেল ঢেলে দূর করে দিয়েছিলেন দোকানি। চোখের সামনে ঘটনাটি দেখে আর থাকতে পারেননি তিনি। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তিকে তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। দিনের পর দিন চিকিত্‌সকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে তোলেন বীরভূমের মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তিকে।

সেই শুরু। তারপর থেকে অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো মানসিক ভাসাম্যহীনদের ধরে এনে যত্ন নেওয়াটাই নেশা হয়ে গিয়েছে নাকাশিপাড়ার মোসলেম মুন্সির। এই ১১ বছরে ছ’শোরও বেশি মানসিক ভারসাম্যহীনকে সুস্থ করে তুলেছেন তিনি। একসময় তো নিজের ঘরের পাশেই ঠাঁই দিতেন রাস্তা থেকে তুলে আনা ওই ব্যক্তিদের। তাঁর স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুশি মনেই মেনে নিয়েছিলেন সেই সহবস্থান। পরে অবশ্য বাড়ির অদূরেই মানসিক ভারসাম্যহীন পুরুষদের জন্য দোতলা থাকার জায়গা তৈরি করেছেন সেরিকালচার দফতরের ওই কর্মী। জনা সাতেক মহিলা অবশ্য রয়ে গিয়েছেন মোসলেম মুন্সির নিজের বাড়িতেই।

মানসিক ভারসাম্যহীনদের বন্ধু হিসেবে মোসলেম মুন্সির নাম ছড়িয়ে গিয়েছে জেলা ছাড়িয়ে ভিন্‌ জেলা ও কলকাতাতেও। নির্মল হৃদয় সমিতি নামে এক সংস্থা গড়ে শিয়ালদহ-হাওড়া কিংবা নানা জেলার বাসস্ট্যান্ড থেকেও মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরেদের নিয়ে আসেন মোসলেম। তার আগে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সমস্ত তথ্যও দিয়ে আসেন। যাতে তাঁর পরিজনেরা প্রয়োজন হলেও পুলিশের কাছ থেকে খোঁজ পেতে পারেন মানুষটার। আবার পুলিশ নিজেও অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীনদের পাঠিয়ে দেয় ওই হোমে। চাপড়া, নাকাশিপাড়া, করিমপুর, কৃষ্ণগঞ্জ এলাকা থেকে বহু মানসিক ভারসাম্যহীনকে তাঁর হোমে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি মোসলেম মুন্সির। আবার কারও কারও বাড়ির লোকেরা এসেও মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের রেখে যান গলাইদড়ির ওই হোমে।

এ কাজে মোসলেম মুন্সি পাশে পেয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেবাশিস দাশগুপ্তকে। নদিয়া জেলা হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে কলকাতায় চলে গেলেও সপ্তাহান্তে একদিন নির্মল হৃদয়ের হোমে আসেন তিনি। দেবাশিসবাবু বলেন, “আমাদের দেশে এমনিতেই মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য ভাল চিকিত্‌সা পরিকাঠামো নেই। তাঁদের প্রতি দরদ দেখানোর লোকেরও বড় অভাব। সেখানে মোসলেমের মতো একজন মানুষকে পেয়েও এগিয়ে আসব না তা হয় নাকি!”

প্রশাসনও বছর খানেক ধরে নির্মল হৃদয় সমিতির কাজকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। নানা সভায় সম্মানিত হয়েছেন মোসলেমও। ডাক পেয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের রিয়ালিটি শো-তেও। গত বছর কলকাতার একটি নামী ক্লাব মোসলেমকে দিয়ে তাদের পুজোর উদ্বোধন করিয়েছে। মোসলেম জানান, শারীরিক সমস্যা নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন কোনও ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হলেও সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁকে কোথায় পাঠানো হবে সে নিয়ে টানাপড়েন চলে। বছর তিনেক আগে নদিয়া জেলা হাসপাতালে এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার দিনকয়েক পরেই গোপনে হাসপাতাল থেকে পালান তিনি। শিশুকন্যাটিকে নিয়ে অকুল পাথারে পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই শিশুরও ঠাঁই হয়েছে ওই হোমে।

তবে সরকারের তরফে আরও একটু সাহায্য পেলে পথটা কিছুটা মসৃণ হতো বলে মোসলেমের দাবি। তিনি বলছেন, “ওষুধপত্র বা কোনও সাহায্যই তো সে ভাবে মেলে না। একা আর পেরে উঠছি না।” তবে মানসিক ভারসাম্যহীনদের থাকার জন্য সাংসদের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে ২০ লক্ষ টাকা মিলেছিল। সবুজ রঙের দশ কামরার দোতলা ভবন তৈরি হয়েছে সেই সাহায্যেই। মিলেছে ২৬টা রেশন কার্ডও। ফলে খাবারের কিছুটা সুরাহা হলেও প্রায় ৫০ জনের বাদবাকি খরচা চেয়েচিন্তেই চালাতে হয় মোসলেমকে। তাতে অবশ্য খেদ নেই তাঁর।

“যখন কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান তখন আর এ সব মনে থাকে না। ভাল থাকা আর ভাল রাখাটা যে এই সময় যে খুব জরুরি।” হাসতে হাসতে বলছেন মোসলেম।

manirul sekh nakashipara moshlem munsi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy