Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শ্রাদ্ধের পরে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ফিরলেন মা

ভিক্ষা করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন বৃদ্ধা মা। পরে ট্রেনে কাটা পড়া একটি দেহ শনাক্ত করে মৃত মা-র সৎকার করেছিলেন ছেলে। তারও প্রায় তিন সপ্তাহ পর শনিবারের বারবেলায় সকলকে অবাক করে দিয়ে সে-ই মা ভ্যানে চেপে ভিক্ষার ঝুলি হাতে বাড়ি ফিরলেন। বৃদ্ধা কালীদাসী দাসের ‘পুর্নজন্মে’ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের আদিত্যপুরের লোকজন।

ছেলের হাতে জলপান মায়ের। —নিজস্ব চিত্র।

ছেলের হাতে জলপান মায়ের। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ধুবুলিয়া শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫৬
Share: Save:

ভিক্ষা করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন বৃদ্ধা মা। পরে ট্রেনে কাটা পড়া একটি দেহ শনাক্ত করে মৃত মা-র সৎকার করেছিলেন ছেলে। তারও প্রায় তিন সপ্তাহ পর শনিবারের বারবেলায় সকলকে অবাক করে দিয়ে সে-ই মা ভ্যানে চেপে ভিক্ষার ঝুলি হাতে বাড়ি ফিরলেন। বৃদ্ধা কালীদাসী দাসের ‘পুর্নজন্মে’ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের আদিত্যপুরের লোকজন। বৃদ্ধা নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে জানালেন, বাড়ির লোকেরা যখন তাঁর শ্রাদ্ধ করছিলেন, তিনি তখন পা ভেঙে চুঁচুড়ায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বছর পঁয়ষট্টির কালীদাসী দাসের স্বামী বিষ্ণুবাবু মারা গিয়েছেন অনেক দিন আগেই। দুই ছেলে দিনমজুরি করে কোনও রকমে সংসার চালান। নিজেদেরই চলে না তো কালীদেবীকে দেখবে কে। অগত্যা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়াতেন কালীদেবী। কখনও কখনও দিনের দিন ফিরতেন বাড়ি। দূরে চলে গেলে দু’তিন পরে। এই ভাবেই ১৯ ফ্রেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

দিন দুই-তিনেক অপেক্ষা করার পরেও কালীদেবী না ফেরায় ২২ ফেব্রুয়ারি ছেলে বিজয় দাস কৃষ্ণগঞ্জ থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। দিন কুড়ি পর, ১০ মার্চ পুলিশ বিজয়বাবুকে থানায় তলব করে জানায়, রানাঘাট জিআরপি-র মর্গে ট্রেনে কাটা পড়া একটি ‘বেওয়ারিশ লাশ’ পড়ে রয়েছে। এ কথা শোনা মাত্রই বিলম্ব না করে বিজয়বাবু ছোটেন মর্গে। সামান্য বিকৃত হলেও মৃতদেহটিকে তাঁর মায়ের বলে চিনতে ‘অসুবিধা হয়নি’। তাঁর কথায়, ‘‘মায়ের মুখের সঙ্গে ওই মৃতদেহের মিল ছিল।’’ মর্গের পাশেই জনা কয়েক পড়শিকে নিয়ে বিজয় দাস ‘মা’-কে দাহ করেন। দিন চারেক পর, ১৪ মার্চ ‘মৃত মা’য়ের নামে শ্রাদ্ধও করে দিন আনি দিন খাই দাস পরিবার। শ্রাদ্ধ পরবর্তী ধর্মীয় বিধানও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন নিকটাত্মীয়রা।

শনিবার কালীদাসীদেবীকে সশরীরে দেখে তাই হতবাক গাঁয়ের লোকজন। সাক্ষাৎ ভুত না জীবন্ত বুঝতে কেউ কেউ কালীদেবীকে চিমটি কাটছেন। বাড়ি ফিরতে পেরে যারপরনাই খুশি কালীদেবী অবশ্য সেই সব গায়ে মাখছেন না মোটেই। বাড়ির একফালি উঠোন ভর্তি গাঁয়ের লোকজনদের তিনি জানালেন, ট্রেনে চেপে ভিক্ষে করতে-করতে সেদিন (১৯ ফেব্রুয়ারি) পৌঁছে গিয়েছিলেন হুগলির চুঁচুড়ায়। সেখানে পথে ভিক্ষে করতে-করতে আচমকা পিছন দিক থেকে আসা একটি ছোট গাড়ির ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে জখম হন। পথচারীরা সঙ্গে-সঙ্গে ভর্তি করেন চুঁচুড়ার একটি সরকারি হাসপাতালে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলতে থাকে। সপ্তাহখানেক পরে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে কালীদেবী জানান, তাঁর বাড়ি কৃষ্ণগঞ্জে। তবে, ছেলেদের মোবাইল না থাকায় এর বেশি কিছু বলতে পারেননি। অবশেষে প্রায় মাস দেড়েক চিকিৎসার পর তাঁকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছুটি দেন। হাসপাতালের লোকজনই কালীদেবীকে নৈহাটি স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তারপর ট্রেন ধরে গেদে আসেন তিনি। সেখান থেকে ভ্যানে করে শনিবার সটান বাড়ি।

পালদহ-মাজদিয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান সুব্রত বিশ্বাস বলেন, “ওই বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন বলেই জানতাম। ফিরে এসেছেন শুনে শনিবার গাঁয়ের লোকেরা সব ভিড় করে। ওই বৃদ্ধা চুঁচুড়া সদর হাসপাতালের কিছু কাগজপত্র দেখিয়েছেন। যেখান থেকে আমরা জানতে পারলাম, বাড়ির লোকেরা যখন চিন্তায় মাথা খুঁড়ছেন, উনি তখন হাসপাতালে ভর্তি।”

মা-কে ফিরে পাওয়ার আনন্দের মধ্যেও একটা ভয় পিছু ছাড়ছে না বিজয় দাসের। কাঁপতে-কাঁপতে জড়ানো গলায় তিনি বলেন, ‘‘যে মহিলাকে মা ভেবে দাহ করলাম, তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা মৃতদেহের দাবি করলে কী হবে? তখন না শ্রীঘরে যেতে হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dhubulia beggar missing mother nadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE