‘নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’ গ্রন্থে পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ বলেছেন, নবদ্বীপ কে সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় নগর বলা হত। অবশ্য তখন নবদ্বীপ বলতে শুধু আজকের নবদ্বীপ শহরটুকুই নয়, উপকণ্ঠে অবস্থিত বিদ্যানগর এবং চারপাশের গ্রামগুলিকেও বোঝাতো। বেলপুকুর, বিল্বগ্রাম, শান্তিপুর, পূর্বস্থলী, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, অম্বিকা কালনা, গুপ্তিপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নবদ্বীপ কেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চা। এই বিরাট এলাকা জুড়ে তখন অসংখ্য চতুষ্পাঠী ছিল।
কিন্তু সেই সুখের সময় বারবার বাধার মুখে পড়ে। তুর্কি আক্রমণের পরে নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার গৌরব ফিরে এসেছিল। কিন্তু তা আবার ম্লান হতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ শাসন পর্বের শুরু থেকেই। বিদেশি শাসকের আনুকূল্য পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে সংস্কৃতকে বাঁচাতে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ ১৮৮৬ সালে এক শিক্ষাসংসদ তৈরি করেন। দেশের প্রাচীনতম সেই শিক্ষাসংসদই নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই শিক্ষা সংসদ গড়ে ওঠে আপোষহীন কিংবদন্তী বুনো রামনাথের ভিটেতে। বিদেশি শাসকের বিরোধিতার মুখে সংস্কৃত চর্চাকে দাপটের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল সেকালের বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। বিদেশি শাসক গিয়েছে বহুকাল। সংস্কৃতের দুঃখ ঘোচেনি। সে আজ “মৃত ভাষা”। বেশ কিছুদিন যাবত বঙ্গ বিবুধ জননী সভা নতুন উদ্যমে সংস্কৃত চর্চায় নবদ্বীপে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৮৮৬ সালে পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহকে সভাপতি এবং অবসর প্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করে দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের এক সঙ্গে নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে একটা সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই সভা স্থাপন করা হয়েছিল।
তবে তা গৌরবময় অতীত। বুনো রামনাথের ভিটের ওপর ৩৮ কাঠা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে বেআইনি ভাবে। এখন অবশিষ্ট আছে ১৫ কাঠা জমি। আছে এক মূল্যবান গ্রন্থাগার আর পোড়োবাড়ির চেহারা নেওয়া ভবন। একশ তিরিশ বছরের ভাষা চর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস বুকে নিয়ে নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার সুদিন ফিরিয়ে আনতে ফের উদ্যোগী হয়েছে বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ এবং শিক্ষানুরাগী একদল মানুষের আন্তরিক উদ্যোগে বছর দুয়েক ধরে সভায় চলছে নানা কর্মকান্ড।