Advertisement
০২ মে ২০২৪
টেটেও সমন্বয়-প্রশ্নে জলঘোলা

নয়া তারিখ ঘোষণা পার্থকে এড়িয়েই

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট নিয়ে জটিলতা কেটেও কাটছে না! তারিখের জট সোমবার যদিও বা কাটল, রাজ্য প্রশাসনে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে মুখর হয়েছে বিরোধী শিবির।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট নিয়ে জটিলতা কেটেও কাটছে না! তারিখের জট সোমবার যদিও বা কাটল, রাজ্য প্রশাসনে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে মুখর হয়েছে বিরোধী শিবির।

নবান্ন সোমবার ঘোষণা করেছে, শিক্ষামন্ত্রীর নির্ধারিত ৪ অক্টোবর নয়, টেট হবে ১১ অক্টোবর। এই ঘোষণা নিয়ে এবং তার আগে-পরে কয়েক অঙ্কের নাটক হয়ে যায় নবান্নে। সেই নাটকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবেশ ও প্রস্থান ঘিরেই জলঘোলা হচ্ছে। সেই সূত্রেই সমালোচনার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন বিরোধীরা।

এ দিন নাটকের প্রথম অঙ্কে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন শিক্ষামন্ত্রীই। তিনিই টেটের তারিখ বদল নিয়ে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে ভিডিও-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ডিএম, এসপি-রা জানিয়ে দেন, পুর নিগমের ভোট এবং অন্যান্য পরীক্ষা থাকায় ৪ অক্টোবর টেট নেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না। শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতেই তখন নবান্নের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়, টেট নেওয়া হোক ১১ অক্টোবর। জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারেরা তাতে সম্মতি জানিয়ে দেন।

নাটক জমে ওঠে এর পরেই। পার্থবাবুর ভিডিও-সম্মেলনে তারিখ বদল চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সংবাদমাধ্যমের কাছে সেটা ঘোষণা করতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিকদের ওই পরীক্ষার পরিবর্তিত তারিখের কথা জানান মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। নবান্নের খবর, তারিখ ঘোষণার এই অঙ্ক থেকে পার্থবাবু বাদ পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই। পার্থবাবু এই নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও
তাঁর অসন্তোষ চাপা থাকেনি। নিজের দফতরের সচিব, পর্ষদকর্তা এবং অন্য অফিসারেরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের মুখোমুখি না-হয়ে সকলের অলক্ষ্যে নবান্ন ছেড়ে চলে যান। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গেও দেখা করেননি।

তারিখ ঘোষণার ভার শিক্ষামন্ত্রীকে দেওয়া হল না কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিক ভাবেই। নবান্নের সঙ্গে কোনও অলোচনা না-করেই শুক্রবার একতরফা ভাবে টেটের নতুন দিন ঘোষণা করেছিলেন পার্থবাবু। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই এ দিন আবার টেটের পরিবর্তিত তারিখ ঘোষণার পর্বে পার্থবাবুকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি কেন অনুপস্থিত ছিলেন, পরে তার ব্যাখ্যা দেন পার্থবাবু। তবে নবান্নে নয়, তৃণমূল ভবনে। তিনি বলেন, ‘‘নবান্নে একটা প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে টেট নিয়ে। তার সাংবাদিক বৈঠকে আমি থাকব কেন? জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারেরা আমার অধীনে কাজ করেন না। পুলিশ তো আমার অধীন নয়। মুখ্যসচিব প্রশাসনের প্রতিনিধি। তাই তিনিই সাংবাদিক বৈঠক করেছেন।’’

প্রশাসনে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে যে-অভিযোগ ও প্রশ্ন উঠছে, মন্ত্রীর এই ব্যাখ্যায় অবশ্য তার নিরসন হচ্ছে না বলেই বিরোধীদের অভিমত। তাঁদের বক্তব্য, সমন্বয়ে ঘাটতির জন্যই এ দিন এত নাটকের অবতারণা।

প্রশ্নপত্রের একটি প্যাকেট লোপাটের পরে শিক্ষামন্ত্রী টেটের পরিবর্তিত তারিখ (৪ অক্টোবর) ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর নির্ধারিত তারিখ বদল হল কেন, তার ব্যাখ্যা গিতে গিয়ে মুখ্যসচিব বলেন, ‘‘৩ অক্টোবর ভোট (আসানসোল ও বিধাননগর-নিউ টাউন পুর নিগম এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ) আছে। ৪ অক্টোবর রয়েছে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার পরীক্ষা। এসএসসি-র কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষাও আছে। বন্যার জন্য অনেক জায়গায় এখনও ত্রাণ শিবির চলছে। সব দিক বিবেচনা করেই ঠিক হয়েছে, ১১ অক্টোবর টেট হবে।’’ ডিএম-এসপিদের সঙ্গে এ দিনের ভিডিও-সম্মেলনে ছিলেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, স্কুলশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতিও। সম্মেলনে ১০-১১ জন (রাজ্যে জেলা ১৯টি) ডিএম-এসপি জানান, পুরভোট রয়েছে। পঞ্চায়েতের উপনির্বাচনও আছে কিছু। এর মধ্যে ৪ অক্টোবর টেট নেওয়া মুশকিল।

সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যসচিব জানান, টেটের নতুন তারিখের ব্যাপারে সবিস্তার নির্দেশিকা-সহ বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে সংবাদপত্রে। ১১ তারিখে কী ভাবে, কোথায়, কখন পরীক্ষার জন্য যেতে হবে, তাতে সবই উল্লেখ করা হবে। প্রার্থীরা যেন সেটা দেখে পরীক্ষা দিতে যান। তিনি আশ্বাস দেন, ‘‘পুরোপুরি স্বচ্ছতা ও গোপনতা বজায় রেখে টেট নেওয়া হবে। সরকার পরীক্ষার্থী এবং তাঁদের বাড়ির লোকের সহযোগিতা প্রার্থনা করছে।’’

টেটের নতুন তারিখ ঘোষণা সত্ত্বেও প্রায় ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থীর বিভ্রান্তি কাটছে না। মুখ্যসচিবের ঘোষণার পরে জানা যায়, ১১ অক্টোবর ডব্লিউবিসিএসের ‘মেন’ পরীক্ষা রয়েছে। একই দিনে দু’-দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা কী করে হবে, সেই প্রশ্নকে ঘিরে নতুন করে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। পরীক্ষার্থীরা সংবাদপত্রের দফতরে ফোন করতে শুরু করেন। পরে মুখ্যসচিব বলেন, ‘‘আমরা নিশ্চয়ই বিকল্প উপায় ভাবব।’’ নবান্ন সূত্রের খবর, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বিসিএসের তারিখ পিছিয়ে দিতে পারে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান উক্তিতে তার ইঙ্গিতও আছে। তিনি এ দিন জানান, ১১ অক্টোবর বিসিএসের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি।

সমস্যা দেখা দিয়েছে টেটের সময়সীমা নিয়েও। মুখ্যসচিবের বৈঠক চলাকালীনই নবান্নে খবর আসে, কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, দেড় ঘণ্টার বদলে টেট নিতে হবে আড়াই ঘণ্টা ধরে। হাইকোর্ট এ দিন রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা গ্রহণের সময়সীমা আড়াই ঘণ্টা করতে হবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব টিচার এডুকেশনের বিজ্ঞপ্তি মেনেই। জুলাইয়ে এক পরীক্ষার্থী হাইকোর্টে এই দাবি জানিয়েছিলেন। সিঙ্গল বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়। সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে যান আবেদনকারী। বিচারপতি গিরীশ গুপ্ত ও বিচারপতি শিবসাধন সাধুর ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন সিঙ্গল বেঞ্চের রায় খারিজ করে দিয়ে জানায়, পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি জারি না-হওয়া পর্যন্ত টেটের সময়সীমা আড়াই ঘণ্টাই থাকবে। শিক্ষামন্ত্রী পরে বলেন, ‘‘হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা আড়াই ঘণ্টা ধরেই শিক্ষক নিয়োগের ওই পরীক্ষা নেব।’’

গোল বেধেছে আরও একটি জায়গায়। পার্থবাবু গত শুক্রবার বিকাশ ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, ২০১২ সালের যে-সব পরীক্ষার্থী অ্যাডমিট কার্ড থাকা সত্ত্বেও অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে পারেননি, তাঁরা আরও একটা সুযোগ পাবেন। ৩১ অগস্ট থেকে তাঁরা আরও এক সপ্তাহ ধরে অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে পারবেন। যথাসময়ে তার বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এ দিন এই বিষয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি। এমনকী পর্ষদের ওয়েবসাইট থেকে কোনও ভাবেই এ দিন অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে পারেননি বহু পরীক্ষার্থী। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে ফোন করে সদুত্তর পাননি বলে অভিযোগ করেছেন তাঁদের অনেকেই।

‘‘আমি জানতে চাই, কোন কোন পরীক্ষার্থী এ দিন অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে পারেননি। অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ ডাউনলোড করতে যদি কোনও সমস্যা হয়, আজ, মঙ্গলবারের মধ্যে তার সমাধান হয়ে যাবে,’’ আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE