Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘ভাল মৃত্যুর উপায়’ কী, বাতলাল শিমুলিয়ার ঘাঁটি

জেহাদের ডাক দেওয়া বেশ কিছু লিফলেট। আরবি, উর্দু, অসমিয়া বই। কিছু বাংলাও। তার একটি ‘ভাল মৃত্যুর উপায়’। সেই বইতে কী রয়েছে, এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেহাদে গিয়ে মৃত্যুই সব চেয়ে ‘ভাল মৃত্যু’ এবং ধর্মপ্রাণ সব মানুষের কাছে সেটাই কাম্য বলে ওই বইতে ‘শিক্ষাদান’ করা হয়েছে। শুধু কি বই? নি-ক্যাপ, এলবো-ক্যাপ, দড়িতে ঝোলানোর স্যান্ডব্যাগ, এয়ারগানের গুলি, তলোয়ার, খুকরি। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে অস্ত্রশিক্ষার ডেরা।

শিমুলিয়ার সেই মাদ্রাসায় এনআইএ। চলছে মাপজোকের কাজ। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

শিমুলিয়ার সেই মাদ্রাসায় এনআইএ। চলছে মাপজোকের কাজ। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

সৌমেন দত্ত
মঙ্গলকোট শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

জেহাদের ডাক দেওয়া বেশ কিছু লিফলেট। আরবি, উর্দু, অসমিয়া বই। কিছু বাংলাও। তার একটি ‘ভাল মৃত্যুর উপায়’।

সেই বইতে কী রয়েছে, এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেহাদে গিয়ে মৃত্যুই সব চেয়ে ‘ভাল মৃত্যু’ এবং ধর্মপ্রাণ সব মানুষের কাছে সেটাই কাম্য বলে ওই বইতে ‘শিক্ষাদান’ করা হয়েছে।

শুধু কি বই?

নি-ক্যাপ, এলবো-ক্যাপ, দড়িতে ঝোলানোর স্যান্ডব্যাগ, এয়ারগানের গুলি, তলোয়ার, খুকরি। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে অস্ত্রশিক্ষার ডেরা। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ায় দ্বিতীয় দিন তদন্তে গিয়ে এনআইএ কর্তারা প্রায় নিশ্চিত, মাদ্রাসা নামের আড়ালে আসলে ক্যারাটে-বক্সিং শিক্ষা থেকে গুলি ছোড়া জঙ্গিদের নানা প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ঘাঁটি ছিল সেটি।

বর্ধমানে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে রবিবারই ওই মাদ্রাসায় বিপুল নথির হদিস পেয়েছিলেন এনআইএ অফিসারেরা। সোমবার সেগুলি পরীক্ষা করা হয়। দিল্লির এক এনআইএ-কর্তা জানান, শিমুলিয়ার মাদ্রাসা থেকে প্রচুর বাংলা নথি পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি খুঁটিয়ে পড়তে পারলে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু দলে তত বাংলা জানা লোক না থাকায় তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন।

কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ওই কর্তার কথায়, “বাংলায় লেখা এক-একটি বই পাওয়া গিয়েছে যা একশো পাতা বা তার চেয়েও মোটা। প্রতিটি খুঁটিয়ে পড়তে হবে। আমাদের দলে তত বাঙালি অফিসার নেই। ফলে, আরও সময় প্রয়োজন।” পাশাপাশি, রাজ্যের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় হানা দেওয়া হয় বলে এনআইএ-র তরফে দাবি করা হয়েছে। তবে শিমুলিয়ার মাদ্রাসা থেকে অসমের যে সব মেয়ের নাম পাওয়া গিয়েছে, তাদের কাউকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি।

প্রচুর জিনিস বাজেয়াপ্ত হলেও শিমুলিয়ার ওই মাদ্রাসার ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকায় বিরক্ত এনআইএ। কারণ, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের দিন তিনেকের মধ্যে মাদ্রাসাটির কথা জেনেছিল পুলিশ। কিন্তু তার পরে দু’-এক বার সেখানে ঘুরে যাওয়া ছাড়া পুলিশ বা সিআইডি আর কিছু করেনি। তার মধ্যে সব সন্দেহভাজনই বেপাত্তা হয়ে যায়। রবিবার এনআইএ-র দল গিয়ে টিন দিয়ে ঘেরা মাদ্রাসার ঘরগুলিতে পড়ে থাকা বিপুল নথিপত্র দেখে অবাক হয়ে যায়। এত দিনেও কেন সেগুলি সংগ্রহ করা হয়নি, তা নিয়ে বিরক্তিও প্রকাশ করে। মাদ্রাসায় বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের ব্যবস্থা করে রাত ১২টা পর্যন্ত নথিপত্র পরীক্ষা করেন অফিসারেরা।

এ দিন সকাল পৌনে ১০টা নাগাদ ফের এনআইএ-র দুই অফিসার ওই মাদ্রাসায় যান। সঙ্গে ছিলেন বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রশান্ত চৌধুরী, এসডিপিও (কাটোয়া) ধ্রুব দাস, মঙ্গলকোটের ওসি সঞ্জয় কুণ্ডু। চার পাশ পুলিশি পাহারায় মুড়ে দেওয়া হয়। কাউকে ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এনআইএ-র ডিএসপি আর কে সিংহের নেতৃত্বে মাদ্রাসার ছ’টি ঘর এক-এক করে খুলে তদন্ত শুরু হয়। পাশের কৃষ্ণবাটি গ্রাম থেকে আরবি ও উর্দু জানা দুই শিক্ষককে ডেকে পাঠানো হয়। প্রায় একশো বই ছিল মাদ্রাসায়। দুই শিক্ষক সেগুলি খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে জেনে নোট নিতে থাকেন এনআইএ অফিসারেরা। দেখা যায়, অধিকাংশ বইয়েই রয়েছে জেহাদ সংক্রান্ত কথাবার্তা।


মিলেছে বই ও অন্য অনেক জিনিসপত্র।

সকাল ১১টা নাগাদ এনআইএ-র দলটি মাদ্রাসার বাড়ি ও আশপাশ ঘুরে দেখেন। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে টুকটাক কথাও বলেন। পুলিশ তাদের জানায়, গ্রামবাসীদের সঙ্গে ইতিমধ্যে তারা কথা বলেছে। এনআইএ-র হাতে সেই রিপোর্ট তুলে দেওয়া হবে। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ বর্ধমান থেকে এনআইএ-র আরও চার সদস্যকে আনা হয়। দুপুর পৌনে ৩টে নাগাদ ডাকা হয় মঙ্গলকোট ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মীদের। তাঁরা এসে বাড়ির ভিতরে-বাইরে মাপজোক করে এনআইএ-কে জানান, আট কাঠা জমির উপরে বাড়িটি তৈরি হয়েছে। পরে, বিকেল সাড়ে ৩টেয় শিমুলিয়া পঞ্চায়েতের সহায়ক শ্রীজাতা দত্তকে ডেকে পাঠিয়ে পঞ্চায়েতের কাছে ওই মাদ্রাসা ও জমি সম্বন্ধে কী তথ্য রয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। রবিবারের মতো এ দিনও সন্ধ্যায় জেনারেটর দিয়ে আলো জ্বেলে তদন্ত চালায় এনআইএ। যা দেখে প্রায় তাজ্জব গ্রামবাসীরা। শিমুলিয়ার নুর মহম্মদ, শেখ সাকের আলিদের কথায়, “যেন সিনেমা দেখছি! আগে আমরা পুলিশের তদন্ত দেখেছি। পুলিশ এসে দেখেশুনে চলে গিয়েছে। কিন্তু এ ভাবে এত দ্রুত এত আয়োজন কখনও দেখিনি।” ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এক পুলিশকর্মীও বলে ফেলেন, “গোয়েন্দা উপন্যাসে যে ভাবে রহস্য ভেদ করার কথা পড়েছি, এখন যেন চোখের সামনে তা-ই দেখছি। মাটিতে পড়ে থাকা চুল থেকে ইটের খোলা, সব কিছুর উপরেই ওঁদের নজর!”গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন শিমুলিয়ার মাদ্রাসা থেকে একটি ছবি মিলেছে। সেটি ডিএসপি নিজের কাছে রেখেছেন। এ ছাড়া মিলেছে স্যান্ড ব্যাগ (বক্সিং অনুশীলনে যেমন ব্যবহার হয়), রোলার স্কেটার, ছ’টি সিম, ৩টি মোবাইল, একটি বড় তলোয়ার, চারটি খুকরি, এয়ারগানের গুলি দু’প্যাকেট। কয়েকটি খাতা মিলেছে যেগুলি থেকে পড়ুয়াদের নাম মিলেছে। তাতে ঠিকানার জায়গায় বাংলাদেশের নানা জায়গার নাম লেখা রয়েছে। বহু ফোন নম্বরও পেয়েছেন এনআইএ কর্তারা। এই মাদ্রাসার পরিচালক ইউসুফ শেখের বাড়ি শিমুলিয়ার পাশের গ্রাম কৃষ্ণবাটিতে। রবিবার রাতে সেখান থেকে ডিভিডি প্লেয়ার, জেহাদি বইপত্র, বিভিন্ন মাদ্রাসার পত্রিকা মিলেছে। বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ বীরভূমের মহম্মদবাজারের দেউচা গ্রামে খাগড়াগড়-বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিমের বাড়িতে যান এসআইবি-র (সাবসিডিয়ারি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) দুই সদস্য। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে হাকিমের বাবা মহম্মদ শাহাজামালকে তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে শাহজামাল জানান, এসআইবি হাকিম সম্পর্কে নানা কথা জানতে চেয়েছিল। হাকিম ছোটবেলা থেকে কোথায় পড়াশোনা করেছে, দেউচার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার যাতায়াত ছিল কি না, বাড়ি-দোকান কবে এবং কী ভাবে হয়েছে, বাকি ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়াশোনা করেছে এ রকম নানা প্রশ্ন তাঁকে করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমার সব ছেলেমেয়েই প্রাথমিক স্কুল ও হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছে। আমার বাড়ি-দোকানঘর বছর ১৫-২০ আগে তৈরি। হাকিম তখন খুবই ছোট।” বোলপুরের মুলুক এলাকায় আবার হবিবুরের খোঁজে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। স্থানীয় আরতি সিনেমা হল লাগোয়া এলাকায় দোকানদারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বর্ধমানে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার আগে হবিবুর ওই এলাকায় কাপড়ের দোকান করেছিল বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর। রাজ্য পুলিশ ও পরে এনআইএ-র তরফে অসম পুলিশের কাছে আইইডি বিশেষজ্ঞ নাসিরুল্লাহ, আবদুল ওয়াহিব, সাজিদ, ইয়াকুব শেখ, মহম্মদ আরিফ হোসে, রিয়াজুদ্দিন, আরিফুল ইসলাম, রিয়াজুদ্দিন, জালু মিঞাঁর নাম অসম পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ দিন পর্যন্ত কারও হদিসই মেলেনি। অসম পুলিশের এডিজি পল্লব ভট্টাচার্য বলেন, “পুলিশি হানার আগেই সকলে পালিয়ে গিয়েছে।” পুলিশ জানতে পেরেছে, বরপেটার এক দাঁতের ডাক্তার বাংলাদেশ থেকে আসা টাকা বহরমপুর, বর্ধমান, নদিয়া, মালদহে পাঠাত। ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কওসরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। কিন্তু, ঘটনার পর থেকে সেই ব্যক্তিও সস্ত্রীক বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে।

অসম পুলিশ সূত্রের খবর, বস্তুত আইইডি বিশেষজ্ঞ, মাদ্রাসার ছাত্রী থেকে টাকা লেনদেনের ফড়ে উধাও সকলেই। পুলিশের দাবি, বিস্ফোরণের পরেই বরপেটার বাড়িতে পালিয়েছিল সইখুল ইসলাম, গোলাম ওসমানি। দ্রুত খবর যায় সমস্ত লিঙ্কম্যান, জামাত সদস্যের কাছে। পুলিশ যত ক্ষণে গ্রামে হানা দিয়েছে, সন্দেহভাজনদের বাড়ি থেকে সব নথি-প্রমাণই হাওয়া। মেলেনি মোবাইলের অতিরিক্ত সিমও। ধৃত ছ’জনের কাছ থেকে মাত্র ৫টি মোবাইল ও ৫টি সিম মিলেছে। সেগুলি থেকেও কল-রেকর্ড মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। জামাতের অন্য লিঙ্কম্যান ও সদস্যেরা গা-ঢাকা দিতে দেরি করেনি। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE