Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ক্ষুব্ধ দুই জেলা

সম্পাদক কমিটিতে চমক নেই সিপিএমে

বড় কোনও চমক নেই। বিরাট কোনও ঝুঁকিও নেই! বিধানসভা ভোটের আগে দলের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থিতাবস্থাই বজায় রাখল আলিমুদ্দিন! সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এ বার নতুন মুখ তিন জন। দলের মহিলা সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মিনতি ঘোষ জায়গা পেলেন রাজ্য নেতৃত্বে।

শিলিগুড়ি পুরসভায় দলকে ক্ষমতাসীন করার পরে সিপিএম সম্পাদকমণ্ডলীতে এলেন অশোক ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মঞ্চে সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

শিলিগুড়ি পুরসভায় দলকে ক্ষমতাসীন করার পরে সিপিএম সম্পাদকমণ্ডলীতে এলেন অশোক ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মঞ্চে সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

প্রসূন আচার্য ও সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

বড় কোনও চমক নেই। বিরাট কোনও ঝুঁকিও নেই! বিধানসভা ভোটের আগে দলের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থিতাবস্থাই বজায় রাখল আলিমুদ্দিন!

সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এ বার নতুন মুখ তিন জন। দলের মহিলা সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মিনতি ঘোষ জায়গা পেলেন রাজ্য নেতৃত্বে। সেই সঙ্গেই শিলিগুড়ির নতুন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য ও বীরভূমের নয়া জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোমকে স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে নিয়ে আসা হল রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে। যে কোনও বৈঠকে যোগ দিতে পারলেও সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, আমন্ত্রিত সদস্যদের সম্পাদকমণ্ডলীতে ভোটাধিকার থাকবে না। এর আগে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী ছিল ১৯ জনের। আমন্ত্রিতদের ধরে এ বার কলেবর দাঁড়াল ১৮। অমিতাভ বসু ও শ্যামলী গুপ্ত প্রয়াত, নিরুপম সেন ও রঘুনাথ কুশারী সম্পাদকমণ্ডলী থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এই চার জনের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে তিনটি।

স্থিতাবস্থা বজায় রাখার এই প্রয়াসও অবশ্য একেবারে মসৃণ ভাবে মেটেনি এ বার! সিপিএমের দুই পুরনো শক্ত ঘাঁটি উত্তর ২৪ পরগনা এবং বর্ধমানের দাপট এ বার খর্ব হয়েছে রাজ্য নেতৃত্বে। সেই ক্ষোভের জেরে বৃহস্পতিবার দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে বর্তমান ও প্রাক্তন দুই সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতে নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নাম পাশ করানোর সময় হাত না তুলে সমর্থন দানে বিরত ছিলেন বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা মিলে ৭ নেতা। উত্তরের নেপালদেব ভট্টাচার্য, বর্ধমানের অচিন্ত্য মল্লিক, অঞ্জু করদের সঙ্গেই সম্পাদকমণ্ডলীর নাম সমর্থনে বিরত ছিলেন শমীক লাহিড়ী, নারায়ণ বিশ্বাসেরা। পরে বৈঠকের দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের বক্তব্যের মধ্যেও নতুন সম্পাদকমণ্ডলী
নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নেপালদেব ও অচিন্ত্যবাবু।

আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে স্থান পেলেও অশোকবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘আমি খুশি!’’ তবে দলের মধ্যেই কারও কারও প্রশ্ন, কেন পূর্ণাঙ্গ সদস্য না করে স্থায়ী আমন্ত্রিত করা হল অশোকবাবুকে? কলকাতায় এ দিন সকালে পৌঁছে ইয়েচুরি ও কারাটই রাজ্যের পলিটব্যুরো সদস্যদের সঙ্গে বসে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নাম চূড়ান্ত করেছেন। পলিটব্যুরোয় আর না থাকলেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই আলোচনায় ছিলেন। দলের অন্দরে ইয়েচুরির যুক্তি, বিগত রাজ্য সম্মেলনেই ঠিক হয়েছিল ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে নতুন কাউকে রাজ্য কমিটিতে নেওয়া হবে না। সেই মাপকাঠিতে ৬৭ বছরের অশোকবাবুকে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আনলে প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার শিলিগুড়ি পুরভোটের ওই সাফল্যের পরে তাঁকে বাইরে রাখলেও ভুল বার্তা যাবে! তাই আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে তাঁকে রেখে রফাসূত্র বার করা হয়েছে। তা ছা়ড়া, রাজ্য কমিটিতে দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, সিপিএমের পলিটব্যুরো এখন ১৬ জনের। কোনও সম্পাদকমণ্ডলীই তার চেয়ে বড় হবে না। তাই ১৬ জনের সীমা ছুঁয়ে ফেলার পরে দু’জনকে আমন্ত্রিত করে জায়গা দেওয়া হয়েছে! কেন্দ্রীয় কমিটির নতুন সদস্য, তফসিলি শ্রেণির রামচন্দ্রবাবুর বয়স ৬০-এর নীচে হলেও তাঁকে অশোকবাবুর মতোই আমন্ত্রিত রাখা হয়েছে। আর মিনতিদেবীকে এনে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে আলিমুদ্দিন। সম্পাদকমণ্ডলীতে একমাত্র মহিলা মুখ হওয়ার পাশাপাশিই তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে দ্বিতীয় প্রতিনিধিও বটে। তাঁর আদি বাড়ি উত্তর দিনাজপুরে।

তবে এ সবই নিয়মগত ব্যাখ্যা। সিপিএম সূত্রের খবর, মূল বিরোধ দেখা দিয়েছিল বিদায়ী রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যেই। এবং তার কেন্দ্রে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেব! দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে তিনি জোরদার সওয়াল করেছিলেন নিজের জেলার নেপালদেব এবং কলকাতার মানব মুখোপাধ্যায়ের জন্য। নেপালদেবের ক্ষেত্রে তাঁর পাশে ছিলেন বর্ষীয়ান নেতা শ্যামল চক্রবর্তীও। কিন্তু দু’জনের ক্ষেত্রেই বুদ্ধবাবু-সূর্যবাবু-সহ রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশের প্রবল আপত্তি ছিল। তা সত্ত্বেও গৌতমবাবু ছিলেন অন়ড়! এক সময়ে তিনি ল়়ড়াই করেন মইনুল হাসানের জন্যও। কিন্তু নেপালদেব-মানবের জন্য তাঁর ওই অবস্থান রাজ্য নেতৃত্বের কাছে এতটাই ক্ষোভের কারণ হয়ে ওঠে যে, উত্তর ২৪ পরগনা কোনও নতুন নামই
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়া হয়নি! যে কারণে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বাইরে থেকে যেতে হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেখা গোস্বামীকেও। আর গৌতমবাবুও এ দিন রাজ্য কমিটির বৈঠকের জন্য আলিমুদ্দিন-মুখো হননি! রাজ্য সম্পাদককে তিনি অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর শরীর ভাল নেই।

একই ভাবে দলের অন্দরে গৌতমবাবুদের প্রবল বিরোধী বর্ধমানের দাবিও খারিজ করে দিয়েছেন সূর্যবাবুরা। গত কয়েক বছরে যে কোনও নির্বাচনের পরেই দুই জেলার নেতৃত্ব রাজ্য কমিটির মধ্যেই পরস্পরের সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধে জড়িয়েছেন। এ বার ইয়েচুরি-সূর্যবাবুরা যেমন গৌতমবাবুর পছন্দের নাম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে রাখেননি, ঠিক তেমনই গৌতমবাবুর বিরোধী বলে পরিচিত বর্ধমানের অমল হালদারকেও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যার রেশ ধরে বর্ধমানের অচিন্ত্যবাবু এ দিন রাজ্য কমিটিতে বলেছেন, তিন বারের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় যাঁরা জেলা সম্পাদক
থেকে পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, তাঁদের রাজ্য নেতৃত্বে নিয়ে আসা হবে বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হল না! যদিও প্রাক্তন জেলা সম্পাদক হয়ে গেলেও দীপক সরকার, অমিয় পাত্রেরা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আছেন। অচিন্ত্যবাবুর চেয়ে ঢের বেশি তির্যক সুরে নেপালদেব রাজ্য কমিটির বৈঠকে মন্তব্য করেন, ‘রাজ্যের ১৬ জন পলিটব্যুরো সদস্য’কে অভিনন্দন! সূর্যবাবু যে হেতু পলিটব্যুরোর চেয়ে বড় সম্পাদকমণ্ডলী না করার কথা বলেছিলেন, তাই এমন বক্রোক্তি!

সিপিএমের অন্দরে আপাতত কৌতূহল, বিধানসভা ভোটের আগে দলে অতীতের দুই প্রভাবশালী জেলা উত্তর ২৪ পরগনা ও বর্ধমানের ক্ষোভ কী ভাবে সামাল দেবেন সূর্যবাবুরা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE