‘বৃষ্টিতে ভিজিস না! জ্বর আসবে।’ শৈশব, কৈশোরে মা, জেঠিমা, কাকিমাদের সাবধানবাণী। কে শোনে কার কথা। আকাশ ভেঙে নামল বর্ষা। দিন নেই, রাত নেই। আঝোরে বর্ষণ। উফ! শতশত ব্যাঙ, নালা-ডোবা বাড়ির সামনে পিছনে ঘ্যাংরঘ্যাং। গলা ফুলিয়ে ডাকতেই থাকে। হাকিমপাড়ায় কাঠের একতলা, কারও দোতলা। কাঁচা রাস্তা, কাঁচা ড্রেন। দরজা খুলেই দেখি, উঠোন জলে টইটম্বুর। কুয়োর জল হাতের নাগালে। খাটা-পায়খানাটা যেন নরক। গরু, বাছুর হাঁস, মুরগি ঘরবন্দি। কুকুরগুলো বারান্দায়। কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিই। আর পড়াশুনো লাটে!
বৃষ্টি নামলে শৈশব ফিরে আসে। বিরামহীন লাগাতার। ফুলেশ্বরী, জোড়াপানি, মহানন্দা ফুলেফঁপে ঢোল। হাকিমপাড়ায় অদূরে পালপাড়া, বর্তমান রেভিন্যু বিল্ডিং, মিত্র নার্সিংহোম (তখন ছিল না) সর্বত্র জল থইথই। দুধমোড়ে জলপ্রপাত। মহানন্দায় কতখানি জল বেড়েছে দেখতে যেতাম যৌবনে। শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি চোখ বুঝে অনুভব করি। দুপুর থেকেই ঘোর অন্ধকার। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বাবা, কাকা, জেঠামশাই-রা ঘরে।
শ্রাবণের সন্ধ্যা নামে। কে যায় বাজারে। ঠাকুর্দার মুদির দোকান (মলয় চক্রবর্তীদের বাড়ির একপাশে ছিল) থেকে কাকা ডিম, পাপড়, মুগডাল নিয়ে আসল। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন। রান্নাঘরে লম্ফ। রাতে খিচুড়ি। পাশের বাড়ি থেকে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে। রান্না ঘরে কাঠের উনুন আর কয়লার উনুন জ্বলছে। জল ঠেঙিয়ে মা গোয়ালঘরে গিয়ে দেখলেন, সব ঠিক আছে কি না। টিনের চাল ফুটো দিয়ে জল পড়ছে। নীচে কাকিমা গামলা দিয়ে রাখলেন। মুড়ি ভাজাও হল এক দফায়। বাবা রেডিও শুনছেন। বানভাসির খবর। ভাইবোনেরা খিচুড়ির গন্ধ শুঁকে ঘোরাঘুরি করছি। নামলেই পিঁড়ি পেতে বসা। তবে ওমলেট অর্ধেক করে। পাপড় কোনও কোনও সময় গোটা। যৌথ পরিবারের বৃষ্টির রাতের অনাবিল আনন্দ, কোথায় হারিয়ে গেল।
হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই। শিলিগুড়ি শহরের রাস্তা তখন জলে ডুবে যেত না। এখন কী যে হয়, অল্প বৃষ্টিতে হাকিমপাড়ার মতো জায়গাও জলমগ্ন হয়ে থাকে। নিকাশি নালার বেহাল দশা ঘোচে না। জনপ্রতিনিধিরা ফি ভোটে নমস্কার করে ভোট চান। কিন্তু, নালা আরও মজে যায়। নদী দখল হয়ে যায়। শিলিগুড়ির মহানন্দার পাড় যেন উন্মুক্ত শৌচাগার হয়ে ওঠে। এখনও কোনও শিশু কাগজের নৌকা ভাসায় নিশ্চয়, কিন্তু মজে যাওয়া নালায় আটকে যায় তা।
খুব বিষণ্ণ লাগে। তারই মধ্যে শৈশবের স্মৃতি, পুরানো শিলিগুড়ির কথা মন পড়ে। সেই অবিরাম বৃষ্টি তরাই-এর ‘অহঙ্কার’ ফিরে এসেছে। আমি পুলকিত। আনন্দে আত্মহারা। এখন জানলার পাশে বসে বৃষ্টি ফোঁটা গোনার চেষ্টা করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy