Advertisement
০৮ মে ২০২৪

আলো নেই, দিনমজুরির ফাঁকে পড়তে হত সন্ধে নামার আগেই

পেশা দিনমজুরি। নেশা পড়াশোনা। তাই সংসার চালানোর জন্য সপ্তাহে ৩ দিন দিনমজুরি করেছে শ্রীকৃষ্ণ সরকার। বাকি ৩ দিন স্কুলে গিয়েছে। ফি রবিবার সন্ধ্যা থেকে কীর্তনের আসরে করতাল বাজানোর কাজেও কামাই দেয়নি কোনওদিন। এত কাজের ধাক্কা সামলেও স্রেফ ভোর থেকে বিকেলের নানা ফাঁকফোকরে পড়ে শ্রীকৃষ্ণ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬০৬ নম্বর। বাড়িতে আলো নেই।

পরিবারের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ। —নিজস্ব চিত্র।

পরিবারের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ। —নিজস্ব চিত্র।

রাজকুমার মোদক
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০২:৪২
Share: Save:

পেশা দিনমজুরি। নেশা পড়াশোনা। তাই সংসার চালানোর জন্য সপ্তাহে ৩ দিন দিনমজুরি করেছে শ্রীকৃষ্ণ সরকার। বাকি ৩ দিন স্কুলে গিয়েছে। ফি রবিবার সন্ধ্যা থেকে কীর্তনের আসরে করতাল বাজানোর কাজেও কামাই দেয়নি কোনওদিন। এত কাজের ধাক্কা সামলেও স্রেফ ভোর থেকে বিকেলের নানা ফাঁকফোকরে পড়ে শ্রীকৃষ্ণ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৬০৬ নম্বর। বাড়িতে আলো নেই। কেরোসিনও তেমন জোটে না। ফলে, বেলাবেলি লেখাপড়া করে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। প্রাইভেট টিউটরের সাহা়য্য নেওয়া তার কাছে স্বপ্ন। তবুও তার নম্বর বাংলায় ৮৪, ইংরেজিতে ৬৬, অঙ্কে ৯৩, প্রকৃতি বিজ্ঞানে ৯১, জীবন বিজ্ঞানে ৯০, ইতিহাসে ৯০ ও ভূগোলে ৯২।

বাবা হরিদাসবাবু দৃষ্টিহীন। ঘুরে ঘুরে দু’চার টাকার ধর্মীয় চটি বই বিক্রি করেন। ভিক্ষাও করেন। মা রংমালা দিনমজুর। তাঁদের আয়ে সংসার চলে না। তাই শ্রীকৃষ্ণও দিনমজুরি করে। ধূপগুড়ির বৈরাতিগুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র শ্রীকৃষ্ণ। বাবা-মা ও তিন বছরের ভাই কানাইকে নিয়ে চার জনের সংসার তাদের। বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় সপ্তাহে রেশনে পাওয়া এক লিটার কেরোসিন তেলই সাত রাতের ভরসা।

জন্মের পর থেকেই গলায় তুলসির মালা। নাক ও কপালে তিলক তার একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করেছে। বাবা, মা, ভাইও তিলকধারী। আজন্ম নিরামিষভোজী। টাকার অভাবে জীবনভর শাক-পাতা খেয়ে বেঁচে থাকতে তার কষ্ট নেই। শ্রীকৃষ্ণ বলে, ‘‘সরকারি চাকরি হলে বাবা-মার দু:খ দূর করব। বাবাকে চোখের ডাক্তার দেখাব। এখন এটাই স্বপ্ন।’’

পাড়ার বাসিন্দারা ওর সাফল্য আনন্দিত। সবার মুখে একই কথা, ‘‘দৃষ্টিহীন বাবার ছেলে দিনমজুরি খেটে যা ফল করল তা একটা দৃষ্টান্ত।’’

কিন্তু, ধূপগুড়ি শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কামাতপাড়ায় শ্রীকৃষ্ণদের বাড়িতে আনন্দটা দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়নি। বাবা হরিদাসবাবু, মা রংমালাদেবীর চিন্তা ছেলেকে পড়াতে গেলে তো অনেক বেশি টাকার দরকার। কোথায় পাব এত টাকা। ৭৫ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাবা হরিদাস বলেন, ‘‘ভিক্ষার টাকায় খাব না ছেলের পড়াশুনা চালাব সেটা ভাবতে গেলেই মাথা ঠিক থাকে না। উঁচু ক্লাসে ভর্তি ছেলেও হয়ত দিনমজুর খাটার সময় পাবে না। আমি সমাজের সবার কাছে ছেলের লেখাপড়ার জন্য সাহায্য চাই।’’ মা রংমালাদেবী ছেলের রেজাল্টের দিনেও কামাই দেননি দিনমজুরির।

আঁচল দিয়ে ঘামে ভেজা মুখ পরিষ্কার করতে করতে বলেন, ‘‘রোদ-বৃষ্টিতে মানুষের জমিতে দিনমজুর খেটে খুব কষ্টে সংসার চালাচ্ছি। দিনে ১০০ টাকা হাজিরা পাই। আরও বেশি করে খাটতে রাজি আছি। তবু ছেলেকে স্কুলে পাঠাব। ও যত দূর পড়তে চায় পড়াব।’’ ছেলে শ্রীকৃষ্ণও বলে, ‘‘পড়া চালিয়ে যেতে চাই। স্কুলের শিক্ষকদের থেকেও খুব সহযোগিতা পেয়েছি।’’

বৈরাতিগুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক বলেন, ‘‘শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়ে দিল একাগ্রতা থাকলে দারিদ্র কখনও পড়াশুনার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ও আমাদের গর্ব। আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব খুশি। ওর পড়াশুনা চালাতে স্কুল থেকে সহযোগিতা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE