আজ পাহাড়ের মন খারাপ। ভাবতেই পারছি না আমার স্কুল কার্শিয়াং ডাউহিলের এ রকম মর্মান্তিক পরিণতি! এই মাত্র দেখলাম ভিডিওটা। দাউ দাউ করে জ্বলছে আমার স্কুলের একটা অংশ, আমার ছেলেবেলা। গলা বুজে আসছে, কী কথা লিখব আমি। কী লিখব আমি?
ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে ডাউহিল স্কুল আমার বাড়ির মতো-ই ছিল। সেই স্কুলে আগুন লেগেছে, ভাবতে পারছি না।
এতটাই মন খারাপ যে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটায় ঢুকতে ভয় পাচ্ছি। আরও কী কী সব শুনতে হবে...। আসলে ধ্বংসের খবর শুনতে এমনিতেই আর মন চায় না। এটা তো আমার নিজের জীবনের অংশ। এত বছরের একটা পুরনো ভবন। একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটা কোন অংশ পরিষ্কার হতে পারছি না। এর সঙ্গে আমার ফেলে আসা দিনের বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বাচ্চা অবস্থায় সেখানে ছুটে বেরিয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছি।
বাবা অর্ধেন্দু শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষকতা করতেন এই স্কুলে। ১৯৬৭ সাল থেকে ২১ বছর বাবা ওখানে কাটিয়েছেন। একটা সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকও হয়েছিলেন। আমরা থাকতাম ভিক্টোরিয়া স্কুলের ক্যাম্পাসে। তখন সেখানেই আমার সমস্ত কিছু। এমনকী, পুজোও কাটতো পাহাড়ে। সে কারণে স্কুল, ওক, পাইনের সারি ঘেরা ক্যাম্পাস আমার কাছ আলাদা জগৎ।
অনেক স্মৃতি এখন শুধুই ছাই। আগুন নেভার পরে ডাউহিল স্কুলের একটি ঘর। ছবিটি তুলেছেন রবিন রাই।
আজ থেকে থেকেই ভেসে উঠছে স্কুলের ছবি। এখনও কানে বাজছে উডেন ফ্লোরের সেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ। নাটকের জন্য এক বার অনেক ক্ষণ ধরে ‘মেকআপ’ নিতে হয়েছিল স্কুলের একটি ঘরে। পুষ্পা লামা বলে এক শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর কাছে আমরা যেতাম। তিনি গানের ক্লাস করাতেন। কবিতা পড়াতেন। স্কুলের ওই ক্যাম্পাসকে ঘিরে গড়ে ওঠা ওই জগৎ। আমার গানের গলা ভাল ছিল বলে তিনি আমাকে আগে দাঁড় করিয়ে দিতেন। স্কুলের ভবন, ক্লাস ঘর, করিডর, আনাচে কানাচে সমস্ত জায়গাই স্মৃতিতে জড়িয়ে।
সারাদিন নানা কাজের মধ্যে আছি। কিন্তু সমানে খচ খচ করছে মনটা। কেউ আগুনটা নেভাতে পারল না? দমকল কি দেরিতে পৌঁছালো? এত বছর রমরম করে চলছে স্কুলটা। কই, আগে তো কোনও দিন আগুন লাগেনি! কী এমন হল? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। স্কুলগার্ল হিসেবেই এত সব প্রশ্ন! আগুন ঘিরে তদন্ত বা আরও নানা মত তৈরি হবে। আমি সে সবের মধ্যে ঢুকতেই চাই না।
আমার শুধু মনে হচ্ছে, জীবন থেকেই কেউ একটা অংশ বাদ দিয়ে দিল। ওই স্কুল, পাহাড় আমায় অনেক দিয়েছে। আজও কৌশিকের ছবিতে পাহাড়ের একটা বড় অংশ থাকে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে জীবনের গল্প বলা। আমিও যেন আজও কোথাও সেই পাহাড়েরই মেয়ে। ডাউহিলের স্কুলই আমায় এমন করে তৈরি করেছে।
আসলে সবই তো ক্ষণস্থায়ী। কালের নিয়মে এক দিন সবই চলে যাবে। কিন্তু যেটা আফসোসের— এই এত বছরের পুরনো স্কুলভবন আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেল! প্রায় দেড়শো বছর হতে চলল স্কুলটার। বাড়িটা নিজেই আস্ত ইতিহাস। এর পর হয়তো নতুন কনস্ট্রাকশন হবে। হয়তো আগের মতোই আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু স্কুলের ওই পুরনো রংগুলো, ওই বারান্দা-জানলা— ওগুলো কি কখনও আর ফিরে আসবে?
প্রাথমিক ভবন ছাই
পুড়ে ছাই হয়ে গেল একশো চৌত্রিশ বছরের পুরনো ডাউহিল স্কুলের প্রাথমিক ভবন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ‘হেরিটেজ’ ঘোষিত স্কুলের দোতলা প্রাথমিক ভবনে আগুন লেগে যায় বলে জানা গিয়েছে। দমকলের ইঞ্জিন পৌঁছলেও সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করতেই ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় লেগে যায় বলে অভিযোগ। তত ক্ষণে দোতলা ভবনের সর্বত্রই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। ভবনটির বেশিরভাগটাই কাঠের তৈরি হওয়ায় সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা পরে যখন দমকল কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, তত ক্ষণে পুরো প্রাথমিক স্কুল ভবনটিই ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy