মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারি সভার মাঠ-প্রস্তুত করতে সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয়ে গিয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। নিচু মাঠ ভরাট করে পাশের রাস্তার উচ্চতায় নিয়ে আসতে ট্রাকে করে বালি-পাথর এনে মাঠে ফেলতে হয়েছে প্রশাসনকে। ক্রমাগত পে লোডার চালিয়ে সেই বালি-পাথর সমান করতে হয়েছে।
গত সোমবার শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি সভার জন্য সেবক রোডের সার্কাস ময়দানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। মাঠটির মালিক বেশ কয়েকজন শরিক। তার মধ্যে এক জন এলাকার এক তৃণমূল কর্মী। সে কারণেই দানা বেঁধেছে বির্তক। শুধু সভার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে কেন মাঠে বালি-মাটি-পাথর ফেলা হল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিএম, বিজেপি এবং কংগ্রেস। এ দিকে, আজ বুধবার কালিম্পঙের ডক্টরস গ্রাহাম হোম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেপচাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। সে কারণে সেখানেও মাঠ সংস্কারের কাজ হয়েছে। সে বাবদও বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
শিলিগুড়ির সভায় মাঠ ব্যবহারের জন্য ওই তৃণমূলকর্মী সরকারের থেকে কোনও ভাড়া না নিলেও, বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, মাঠটি বছরের নানা সময়ে বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দেওয়া হয়। রাস্তা থেকে নিচু থাকায় মাঠ ব্যবহারে সমস্যা হতো বলে অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রীর সভার জন্য সরকারি উদ্যোগে মাঠ ভরাট করে দেওয়ায় এবার থেকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে সুবিধে হবে বলে বিরোধীদের দাবি। ভাড়ার দরও বাড়বে বলে অভিযোগ। এমনকী ভবিষ্যতে সেখানে নির্মাণ কাজের পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে বিরোধী পক্ষের কয়েকজন নেতা-কর্মী প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর সভা করার জন্য শিলিগুড়ির অন্যত্র কোনও উঁচু জমি চিহ্নিত করা যেতে পারত, যেখানে জমি ভরাট করার প্রয়োজন ছিল না।
প্রশাসনের একটি সূত্রই জানিয়েছে, ওই জায়গাটি শিলিগুড়ি পুরসভার ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে হলেও প্রশাসনিক ভাবে জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে। মুখ্যমন্ত্রীর সভার জন্য ওই মাঠ ঠিক করার তদারকি করে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। জেলাশাসকের দফতর থেকে মাঠ ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হয় পূর্ত দফতরের কনস্ট্রাকশন বিভাগকে। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকার বলেন, “মাঠটি বৃষ্টিতে জল, কাদায় ভরা ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সভায় আসা বাসিন্দাদের বসতে দাঁড়াতে যাতে সমস্যা না হয় সে জন্যই মাটি ফেলে সমান করে ব্যবহারের উপযুক্ত করা হয়েছে।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য এ বিষয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “শিলিগুড়িতে কোনও দলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী আসেননি। প্রশাসনিক সভা ছিল। সে কারণে নিরাপত্তা এবং আয়োজনে যতটুকু ব্যবস্তা করা হয়, তাই হয়েছে। সভার প্রস্তুতিতে সবসময়েই কিছু খরচ হয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সরকারি নিয়ম মেনেই খরচ হয়েছে।”
সভাস্থলের ওই জমিটির মালিকানা একাধিক শরিকের নামে। তাঁদের অন্যতম কবিলাল বর্মন। মাঠের এক কোণাতেই থাকেন তিনি। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে তিনি দলের সদস্য। ডাবগ্রাম অঞ্চলের সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। বাড়ির সামনে ৫ বিঘার মাঠটি দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক ভাবে ভাড়া দেওয়া হয়। ফি বছর মাঠে সার্কাস বসে বলে মাঠটি সার্কাস ময়দান বলেই পরিচিত। বাড়ির পেছন দিকের মাঠে পার্কিং সহ নানা ব্যবসা রয়েছে বর্মন পরিবারের। দীর্ঘদিনের তৃণমূল কর্মী হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর সভার জন্য অবশ্য ভাড়া নেননি বলে দাবি করেছেন অশীতিপর কবিলালবাবু।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা দার্জিলিং জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “শিলিগুড়িতে কী আর কোনও মাঠ ছিল না? ওই মাঠ ঠিক করে সভা করা রীতিমতো অপব্যয়। ওই মাঠের মালিক ব্যবসায়ী তথা তৃণমূল কর্মীকে সুবিধে পাইয়ে দিতেই সেখানে সভা করার পরিকল্পনা কি না সেটাও দেখতে হবে।” একই প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। জেলা বিজেপির সভাপতি রথীন বসু বলেন, “শুনেছি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীই গোটা পরিকল্পনা করেছেন। দলের লোককে সুবিধা পাইয়ে দিতেই মুখ্যমন্ত্রীর সভার নামে অন্তত কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে মাঠটি সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে বলে আমাদেরও সন্দেহ।” দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি শঙ্কর মালাকারও ওই মাঠ ব্যবহারে কোনও অভিসন্ধি রয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর অভিযোগ, “নানা দুর্নীতিতে রাজ্য সরকার জর্জরিত। তাতে আরও একটি অভিযোগ যোগ হল।”
মাস তিনেক আগে অন্তত ৩০ হাজার টাকা খরচা করে পে-লোডার লাগিয়ে মাঠের কিছু অংশ সমান করার চেষ্টা করেন বলে কবিলালবাবু জানিয়েছেন। যদিও, বর্ষার শুরুতেই তা আবার পুরোনো চেহারায় ফিরে যায়।
মাঠটি রাস্তা থেকে অন্তত ফুটখানেক নিচু ছিল বলে কবিলালবাবু জানিয়েছেন। অন্তত তিন দিন ধরে ওই ভরাটের কাজ হয়। বিরোধীরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলায় বিরক্ত কবিলালবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সভার জন্য কোনও ভাড়া না নিয়ে মাঠ দিয়েছি। সেই মাঠে সভার জন্য উপযুক্ত করেছে প্রশাসন। সেটাই তো স্বাভাবিক। অন্য কোনও মাঠে হলেও এমন হতো। আমার পরিবারকে ব্যবসায়ীক দিক থেকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ অবাস্তব এবং অবান্তর।”
তবে মাঠ নিচু থেকে উঁচু হওয়ায় বাণিজ্যিক দর যে বাড়বে, সে প্রসঙ্গে কবিলালবাবু বলেন, “তাতে আমার কিছু করার নেই। আমি তো মাঠ ব্যবহার করতে দিয়েছি। সেই মাঠ উঁচু করে দেওয়া হোক এমন দাবি তো করিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy