পুরসভার পরে মহকুমা পরিষদ। ভোট সামনে আসতেই শিলিগুড়িতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে সব দল। হাতিয়ার, স্মার্ট সিটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক। সেই বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েই পালে হাওয়া টানতে চাইছে সকলে।
কেন্দ্রের প্রকাশিত স্মার্ট সিটির তালিকায় শিলিগুড়ির নাম না থাকার ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই ক্ষোভ ছড়ায় শহরের নাগরিক সমাজে। সেই ক্ষোভকে ভোটবাক্সে কাজে লাগানোর তাগিদেই পরস্পরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সিপিএম-তৃণমূল-বিজেপি। শিলিগুড়ি স্মার্ট সিটি হলে তার সুবিধা মিলত মহকুমার সব গ্রামের বাসিন্দাদেরও। ফলে, শিলিগুড়িকে ‘বঞ্চনার’ অভিযোগ যে ভোটের হাতিয়ার হতে চলেছে তা বুঝতে পারছে সব পক্ষই। কার্যত সে জন্যই শনিবার পালা করে প্রায় সব প্রধান দলই সাংবাদিক বৈঠক করে একে অন্যকে দুষেছে।
স্মার্ট সিটির জন্য শিলিগুড়ির নাম রাজ্য পাঠায়নি বলে গত দু’দিন সরব হয়েছিল বাম-বিজেপি। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে তার ‘জবাব’ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। এ দিন নিজের দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে গৌতমবাবু এর দায় মেয়র অশোক ভট্টাচার্য় এবং বাম পুরবোর্ডের উপর চাপিয়েছেন। তিনি অভিযোগ তুলেছেন, রাজ্যের তরফে পুরসভাগুলিকে ডেকে সভা করে কী কী করতে হবে তা জানানো হয়েছিল। অশোকবাবু সেই সভাতেও ছিলেন। পুরবোর্ড মিটিংয়ে স্মার্ট সিটির প্রস্তাব গ্রহণ করে পাঠানোর কথা এবং নাগরিক কনভেনশন করে বাসিন্দাদের রায় জানাতে হত। এই দুটোই শিলিগুড়ি পুরসভা করে পাঠায়নি। এর দায় নিয়ে অশোকবাবুর পদত্যাগ করা উচিত অথবা মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
মেয়র অশোকবাবু পাল্টা জানিয়েছেন, না-জেনেই গৌতমবাবু এ সব বলছেন। পুরবোর্ডে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা রাজ্যের কাছে পাঠানো হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা-সহ তৃণমূলের অন্য কাউন্সিলররাও তাতে মত দিয়েছিলেন। তবে নাগরিক কনভেনশন করে পাঠানোর কোনও কথা ছিল না। মেয়র বলেন, ‘‘গৌতমবাবুর বোঝা উচিত, আকাশে থুতু দিলে নিজের গায়েই পড়ে! আমাদের দিক থেকে বোর্ডের সভায় প্রস্তাব নিয়ে সমস্ত কিছু করে পাঠানো হয়েছিল। রাজ্যের তরফে কেন্দ্রের কাছে তা সুপারিশ করার কথা ছিল। কেন্দ্রের কথা মতো এই রাজ্যে চারটি শহরকে স্মার্ট সিটি করার প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়। রাজনীতি করতে গিয়ে রাজ্যের তরফে শিলিগুড়ির নামই পাঠানো হয়নি বলে জানতে পেরেছি।’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘পদত্যাগ আমার নয়, গৌতমবাবুর-ই করা উচিত। তাঁরাই তো ক্ষমতায় রয়েছেন। তাঁদের তরফেই সুপারিশ করার কথা। তবে দিল্লিতে গিয়ে বিভিন্ন পরিচিতদের মুখেই শুনেছি শিলিগুড়িকে নাকি করা হচ্ছে না। অথচ রাজ্যের কোনও শহর ওই সুযোগ পেলে শিলিগুড়িরই পাওয়া উচিত।’’ অশোকবাবু জানান, শীঘ্রই বিষয়টি নিয়ে তাঁরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সভা করবেন, নাগরিক কনভেনশন করবেন।
তবে পুরসভা এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, গত জুন মাসে রাজ্যের তরফে পুরসভাগুলিকে নিয়ে বৈঠক করে কী কী করতে হবে জানানো হয়েছিল। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সমস্ত কিছু জানানোর শেষ সময় ছিল। সেই প্রসঙ্গে গৌতমবাবুর অভিযোগ, ‘‘অশোকবাবুর ভুলের জন্য যোগ্যতা অর্জন পর্বের আগেই শিলিগুড়ি বাদ গিয়েছে। অথচ তিনি মানুষকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তিনি ভাবছেন পুরসভার তরফে প্রস্তাব না পাঠানো, নাগরিক কনভেনশন করে তা না জানানোর বিষয়টি কেউ জানবেন না।’’ অশোকবাবুর দাবি, ‘‘কলকাতায় রাজ্য সরকারের তরফে যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল সেখানে আমি জানিয়েছি, আমরা নীতিগত ভাবে স্মার্টসিটির বিরুদ্ধে। তবে তা সত্ত্বেও শিলিগুড়িকে স্মার্ট সিটি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলাম।’’
বসে নেই বিজেপিও। বিজেপির জেলা সভাপতি রথীন বসু জানিয়েছেন, শিলিগুড়িতে স্মার্ট সিটি নিয়ে আন্দোলনে নামবেন তারা। সই সংগ্রহ এবং নাগরিক কনভেনশনও করা হবে দলের তরফে। রথীনবাবুর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার শিলিগুড়ির নাম না পাঠিয়ে উত্তরবঙ্গকে বঞ্চনা করেছে। এখনও দু’টি শহরের নাম ঘোষণা বাকি রয়েছে। আমাদের দাবি, দ্রুত রাজ্য সরকার শিলিগুড়ির নাম পাঠাক, তার পরে আমরা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে শিলিগুড়ির অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করব।’’
শহর শিলিগুড়ি দার্জিলিঙের সাংসদ এলাকার মধ্যেই পড়ে। তাই কেন্দ্রে বিজেপির সরকার থাকায় স্থানীয় সাংসদ বিজেপির সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকেও পাল্টা একহাত নিয়েছেন গৌতমবাবু। মন্ত্রীর কটাক্ষ, ‘‘দার্জিলিংকে বিশেষভাবে স্মার্ট সিটির মধ্যে আনার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সাংসদ তা নিয়ে কিছুই করেননি। তিনি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনে জিতেছেন। পাহাড়ে তারা ক্ষমতায় রয়েছে। মোর্চাকে সঙ্গে নিয়ে কালিম্পং, কার্শিয়াং, দার্জিলিংকে নিয়ে স্মার্ট সিটির বিশেষ প্যাকেজের জন্য পাঠাতে পারতেন। কেন্দ্রে তো সাংসদেরাই ক্ষমতায় রয়েছেন। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না!’’
বিজেপি অবশ্য জমি ছাড়তে রাজি নয় তৃণমূল-সিপিএম কাউকেই। মন্ত্রীকে বিঁধে রথীনবাবুর অভিযোগ, ‘‘স্মার্ট সিটির জন্য উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বারবার সাংসদের প্রসঙ্গ তুলছেন। রাজ্য নাম পাঠালে সাংসদ সুপারিশ করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্য কেন নাম পাঠাল না সে বিষয়ে গৌতমবাবুকে শিলিগুড়ির বাসিন্দাদের জবাব দিতে হবে।’’ গৌতমবাবুর মতোই মেয়র অশোকবাবুর বিরুদ্ধেও সুর চড়িয়েছেন রথীন। সম্প্রতি অশোকবাবু দিল্লিতে গিয়ে নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে তাঁর অভিযোগ, ‘‘অশোকবাবু প্রথমে বলেছিলেন স্মার্ট সিটি চাই না। পরে বলছেন আন্দোলন করবেন। কখন কী বলছেন, উনি নিজেই বুঝতে পারছেন না। অশোকবাবু সস্ত্রীক দিল্লিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলেন শুনেছি। তিনি কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলেন। তখনই তো এ বিষয়ে জেনে নিতে পারতেন।’’
তবে এই তিন দলের মতো এখনও ‘ফ্রন্টফুটে’ যাচ্ছে না কংগ্রেস। দলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি (সমতল) শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলে তো স্মার্ট সিটি আসবে না। শিলিগুড়ির তার নিজের যোগ্যতাতেই এই তালিকায় থাকার কথা ছিল। তা না হওয়াটা কেন্দ্র-রাজ্য দু’পক্ষেরই ব্যর্থতা। মানুষ এর জবাব দেবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy