শহরের বহু নিকাশি নালার হাল এমনই। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
শহরের রাস্তা সম্প্রসারণ হয়ে ডিভাইডার হয়েছে, বিভিন্ন মোড়ে বসেছে উঁচু আলোকস্তম্ভ, সন্ধে থেকে রাতভর অত্যাধুনিক এলইডি আলোয় ঝলমলে করে শহর। তবে, কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলে থাকেন, শহরের নিকাশি কাঠামোয় এখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে।
এই কটাক্ষের কারণ খোঁজ করে জানা গেল, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জনবহুল শহরের প্রাণকেন্দ্র কদমতলা মোড়ের রাস্তার পাশে দু’টি বড় কালর্ভাট রয়েছে। ১৮৮৫ সালে পুরসভা গঠনের পরে যখন শহরে কয়েকটি ‘হাইড্রেন’ তৈরি করা হয়, কদমতলা মোড়ের নিকাশি ব্যবস্থাও ,তখনই তৈরি হয়। এরপরে নানা সময়ে শহরের বিভিন্ন এলাকার নর্দমা সংস্কার হলেও, কদমতলা মোড়ে হাত পড়েনি বলে জানা গিয়েছে। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিনের নর্দমা কাঠামো বর্তমানে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। একশো বছরেরও বেশি আগে তৈরি সেই নর্দমায় জলবহন ক্ষমতাও সামান্য। সে কারণেই মিনিট পাঁচেকও নাগাড়ে বৃষ্টি হলে কদমতলা মোড় লাগোয়া এলাকা এখনও জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রের যদি এমন অবস্থা, তবে অন্য এলাকার চিত্র কেমন?
ইলশেগুঁড়ি বা মাঝারি, বৃষ্টি যেমনই হোক না কেন, পান্ডাপাড়া যে জলমগ্ন হবে তা নিয়ে বছর কয়েক আগেও বাসিন্দাদের সংশয় ছিল না। অশোকনগর, বউবাজার, মহায়ামায় পাড়া, জয়ন্তী পাড়ার বাসিন্দারাও আকাশে কালো মেঘ দেখে, জলবন্দি হওয়ার আশঙ্কায় ভুগতেন। রায়কতপাড়া, বয়েলখানা, সেনপাড়ার কিছু এলাকায় এখনও বর্ষার সময়ে করলা নদীর জল ঢুকে পড়ে। যদিও, সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে বলে বাসিন্দাদের একাংশের দাবি। বৃষ্টি হলেই পান্ডাপাড়া জলমগ্ন হয়ে থাকছে না। কিছুু পরে জল নেমে যাচ্ছে বলে বাসিন্দারা দাবি করেছেন।
শহরের জলবদ্ধতার সমস্যা কাটাতে ১০০ কোটি টাকার ‘মাস্টার প্ল্যান’ এখনও দিনের আলো দেখেনি। প্রকল্পে কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারের আর্থিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সে প্রকল্পের কাজ কবে থেকে শুরু হতে পারে, তার কোনও নিশ্চয়তা এখনও পুরসভার কাছে। তবে গত কয়েক বছরে সেচ দফতচর এবং পুরসভার তরফে ছোট ছোট কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় নিকাশি পরিকাঠামো বদলাতে শুরু করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। শতবর্ষ পুরোনো কদমতলার নর্দমা সংস্কারের জন্য ৬ কোটি টাকার প্রকল্পের অমুমোদন পেয়েছে পুরসভা। কর্তৃপক্ষের দাবি, দ্রুত এর কাজ শুরু হবে। ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পান্ডাপাড়া-সহ কয়েকটি এলাকার নর্দমা সংস্কারের সুফল মিলেছে বলে পুর কর্তৃপক্ষের দাবি। ৫ কোটি টাকার গদাধর প্রকল্পের কাজ বছরখানেক থমকে থাকলেও, ফের শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে শহরের গদাধর খালকে সংস্কার করে পাঙ্গা এবং করলা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এই খালের মাধ্যমে শহরে জমে থাকা সিংহভাগ জল বেরিয়ে যাওয়ার পথ পাবে বলে বিশেজ্ঞদের দাবি। সেই সঙ্গে করলা অ্যাকশন প্রকল্প তো রয়েইছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে সেচমন্ত্রী এসে ১৬ কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যান মোহন বসু বলেন, “নিকাশি প্রকল্প নিয়ে গত তিন দশকে নানা পরিকল্পনা হয়েছে। সেগুলি যথাযথ রূপায়িত হলে শহরের চেহারাই বদলে যেত। যাই হোক পুরসভাই ছোট ছোট প্রকল্প নিয়ে নিকাশির খোলনলচে বদলাতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেই রাজ্য সরকারের থেকে ৬ কোটি টাকার অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে। তা ছাড়া করলা অ্যাকশন প্ল্যান রূপায়িত হলে, সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।”
সেচ দফতরের দাবি, তিস্তার নদী খাত করলার থেকে বেশ কিছুটা উপরে থাকায় দুই নদীর মোহনা লাগোয়া এলাকায় জলের প্রবাহ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। করলা নদীর জল তিস্তায় মিশতে না পেরে, আটকে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় নদীর জলপ্রবাহ। বর্ষার সময় শহরের করলা নদী দিয়ে বের হতে না পেরে উপচে শহরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে। অ্যাকশন প্রকল্পে মোহনায় নদীর গতিপথ আড়াই কিলোমিটার বাড়িয়ে নদীখাতের উচ্চতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। যার ফলে একদিকে, সারা বছর সহজেই করলার জল তিস্তায় পড়বে সেই সঙ্গে বর্ষার সময়ে জলবদ্ধতার দুর্ভোগও এড়ানো যাবে বলে দাবি।
তবে প্রকল্প রূপায়ণের আগে অবশ্য আশ্বাসে ভরসা রাখতে রাজি নয় শহরের ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। শহরের প্রবীণ আয়কর আইনজীবী তথা শিক্ষক মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভেনিস শহরে গিয়েও অন্যদের মতো খুব একটা অবাক হইনি। মনে হয়েছিল, এই শহরটা তো আমাদের বর্ষার জলপাইগুড়ি। মনে আছে ছোটবেলায় শহরের বেশিরভাগ রাস্তাগুলি জলমগ্ন থাকত। ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার অবশ্য একটা উত্তেজনা ছিল, এখন সেটিকে দুর্ভোগ মনে হয়।” মিহিরবাবুর কথায়, “করলা অ্যাকশন প্ল্যানের কথা শুনেছি। দেখা যাক, আগামী বর্ষায় দুর্ভোগ কতটা লাঘব হয়।”
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy