Advertisement
১০ মে ২০২৪

চাষ, বাড়ি... সবই নদী বেচে

শেষ হয়ে যাচ্ছে নদী। কোনওটার চরে গজিয়ে উঠছে চাষের জমি, কোনওটির চরে ঘরবাড়ি। আর সেগুলি চাষ করতে গিয়ে, বেচে টাকা কামাচ্ছেন এক শ্রেণির নেতা। এই তালিকায় যেমন রয়েছে সাহু বা গুলমার মতো ছোট নদী, তেমনই বাদ যায়নি তিস্তা বা মহানন্দাও। নদী দখল ও তার জমি বিক্রি নিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন।মাটিগাড়ায় বালাসন নদীর চর দখল হচ্ছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। গত কয়েক বছরে তা আরও বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত এক হাজার পরিবার সেখানে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছে।

নদী চোরদের হাতে পড়ে বালাসনের এমনই হাল। চর জুড়ে ক্রমাগত চলছে বালি তোলার কাজ। আর তাতেই নদী ক্রমে মরে যাচ্ছে।  — সন্দীপ পাল

নদী চোরদের হাতে পড়ে বালাসনের এমনই হাল। চর জুড়ে ক্রমাগত চলছে বালি তোলার কাজ। আর তাতেই নদী ক্রমে মরে যাচ্ছে। — সন্দীপ পাল

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৭
Share: Save:

বালাসন: নদী বেচে বাড়ি-গাড়ি

মাটিগাড়ায় বালাসন নদীর চর দখল হচ্ছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। গত কয়েক বছরে তা আরও বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত এক হাজার পরিবার সেখানে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছে। তৃণমূল নেতাদের একাংশ সক্রিয় ভাবে জমির কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগও রয়েছে। দলের মধ্যেও তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। দলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ তা নিয়ে মাস কয়েক আগে বিএলআরও অফিসে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন। ভূমি রাজস্ব দফতরের ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। দলের এক নেতা নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতি ঘুরিয়ে নদীখাত বিক্রির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগও উঠেছিল। একাধিক নেতা নদী দখলের ব্যবসার সুবাদে গাড়ি কিনেছেন। বাড়ি করেছেন।

বাগডোগরায় বুড়ি বালাসন নদীর খাতেও জায়গা দখল হয়েছে। সেখানে শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর জওয়ানদের থাকার জায়গা, অফিস রয়েছে। লাগোয়া নদীর চর ‘প্লট’ করে বিক্রি করা হয়েছে। প্রশাসনের কাছে জানিয়েও কাজ হয়নি বলে অনেকেই ক্ষুব্ধ।

সাহু: লেনদেন ৫০ লাখ

শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যা তৈরির সময়ে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলিকে সাহু নদীর পাশে কলোনি তৈরি করে বসিয়েছে প্রশাসনই। কলোনির নাম ‘অধিকার পল্লি।’ এলাকায় বিদ্যুৎ, রাস্তা তৈরি হয়েছে। তাতেই নদীর পাড়ের জমির দাম লাফিয়ে বেড়েছে। সেই সুযোগে দখল হতে শুরু করেছে খাসজমি থেকে নদীর চর। অভিযোগ, এই চক্রে সক্রিয় এলাকার একাংশ ব্যবসায়ী, যাঁরা তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। নদী চরের অনেকটা এলাকায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে ঘিরে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও বোর্ডে ঘেরা জায়গাটি ‘ইকো পার্ক’, কোথাও বনভোজনের জন্য সংরক্ষিত বলে লেখা হচ্ছে। কিছু দিন বাদেই সেই ঘেরা জায়গার বিভিন্ন প্রান্তে দরমা বেড়ার ঘর গজিয়ে উঠছে। রাতের অন্ধকারে সেই ঘরের মেঝেতে কংক্রিটের ঢালাইও হচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবি, প্রথমে এলাকার মাতব্বরেরা বাঁশের খুঁটি পুঁতে চরের এলাকা ঘিরে দেন। তার পরে মোটা টাকার বিনিময়ে ঘেরা জায়গায় বাড়ি তৈরির অনুমতি দেন। সাহু নদীর চরে জমি পেতে ‘মাসিক বন্দোবস্ত’ করতে হয় বলে শোনা যায়। প্রথমে জমির জন্য মোটা টাকা সেলামি দিতে হয়, পরে মাসে মাসে জমির বাড়া গুণতে হয়। সূত্রের খবর, পনেরো ফুট বাই কুড়ি ফুট জমির জন্য প্রথমে এককালীন অন্তত ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। প্রতি মাসে দিতে হয় পাঁচশো টাকা। বাসিন্দাদের অভিযোগ, শিলিগুড়ি লাগোয়া বাইপাস এলাকা থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত সাহু নদীর চর দখল করে অন্তত দু’শো ঘর তৈরি হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি মাসেই চরের জমির ভাড়া ১ লক্ষ টাকা ওঠে। এককালীন হিসেব যোগ করলে ৫০ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। ফকদইবাড়ি হাট, কৃষ্ণনগর হাট, জলেশ্বরী হাট, হাতিয়াডাঙা এলাকায় সাহু নদীর চরে বসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় নেতাদের হাত ধরেই চলে জমি কেনাবেচা।


এখানে এক দিন সাহু নদী ছিল, বোঝাচ্ছে এই জলধারা।
আর দূরে ওই রেল ব্রিজ। — বিশ্বরূপ বসাক

চাষেও পিছিয়ে নেই সাহুর জমি। শীতের শুরুতে সুখা সাহু নদীর খাত ঘিরে ফ‌েলা হয় টিনের বেড়া দিয়ে। মোটা টাকার বিনিময়ে ঘেরা জমিতে চাষের ইজারা দেওয়া হয়। ফারাবাড়ি-ফকদইবাড়ির বিভিন্ন এলাকায় সাহু নদীর চরে মাথা দোলাচ্ছে সবুজ ধানের গাছ।

এক মরসুমে চাষের জন্য বিঘা প্রতি নেওয়া হচ্ছে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পূর্ব ফকদইবাড়ির এক কৃষক জানান, আট হাজার টাকা দিয়ে তিনি বিঘাখানেক জমি নিয়েছেন চাষের জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘চরের জমিতে ভাল ফসল হয়। নদীতে পলি জমে, সেই মাটিতে সারও দিতে হয় না, জলসেচের খরচও বাঁচে।’’

তবে সেই কৃষক জানালেন, চাষের জমি ইজারা নেওয়ার দর সবসময়ে এক থাকে না। বললেন, ‘‘যেখানে যেমন দর ওঠে, তেমনিই টাকা দিতে হয়।’’ সাহুডাঙি থেকে ফকদইবাড়ি, ফারাবাড়ি, হাতিয়াডাঙার বিস্তীর্ণ এলাকায় অন্তত একশো বিঘা জমিতে চাষের ইজারা দেওয়া হয়েছে। চাষের ইজারা থেকেই এক মরসুমেই জমির কারবারিদের পকেটে ঢোকে অন্তত ১০ লক্ষ টাকা। (চলবে)

বালাসন: নদী বেচে বাড়ি-গাড়ি

মাটিগাড়ায় বালাসন নদীর চর দখল হচ্ছে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। গত কয়েক বছরে তা আরও বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত এক হাজার পরিবার সেখানে জমি কিনে বসবাস শুরু করেছে। তৃণমূল নেতাদের একাংশ সক্রিয় ভাবে জমির কারবারের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগও রয়েছে। দলের মধ্যেও তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। দলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ তা নিয়ে মাস কয়েক আগে বিএলআরও অফিসে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন। ভূমি রাজস্ব দফতরের ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। দলের এক নেতা নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতি ঘুরিয়ে নদীখাত বিক্রির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগও উঠেছিল। একাধিক নেতা নদী দখলের ব্যবসার সুবাদে গাড়ি কিনেছেন। বাড়ি করেছেন।


তিস্তার এক এক জায়গায় এক এক দশা। কোথাও তার বুকে উঠেছে পাকা বাড়ি।
কোথাও চরে এমন ভাবে চাষ হয়েছে, যে বোঝার উপায় নেই, সেখানে কোনও কালে আদৌ কোনও নদী ছিল।
নদী তো এখনও আছে। ওই যে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে তার তিরতিরে জল রেখা। — নিজস্ব চিত্র

বাগডোগরায় বুড়ি বালাসন নদীর খাতেও জায়গা দখল হয়েছে। সেখানে শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর জওয়ানদের থাকার জায়গা, অফিস রয়েছে। লাগোয়া নদীর চর ‘প্লট’ করে বিক্রি করা হয়েছে। প্রশাসনের কাছে জানিয়েও কাজ হয়নি বলে অনেকেই ক্ষুব্ধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

River Farming
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE