Advertisement
০৪ মে ২০২৪

চোলাই নিয়ে চিন্তা

চোলাই মদ যে বিক্রি হচ্ছে, তা সকলেই জানেন। কোথায় বিক্রি হয়, তাতে কী কী মেশানো হয়, তা নিয়ে প্রশাসনের নজরদারির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ অনেক দিনেরই। শান্তিপুরে বিষমদ কাণ্ডের পরে এ বার উত্তরের জেলাগুলিতে চোলাই মদ চিত্র নিয়ে এই প্রতিবেদন। রাস্তার ধারের হোটেলের একাংশে সন্ধ্যার পর চলছে চোলাই ব্যবসা। দীর্ঘদিন ধরেই রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ ও ইটাহার ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় চোলাই মদের রমরমা কারবার বলে অভিযোগ। 

প্রচার: চোলাই মদের বিরুদ্ধে। বালুরঘাটে। নিজস্ব চিত্র

প্রচার: চোলাই মদের বিরুদ্ধে। বালুরঘাটে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
রায়গঞ্জ শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৩
Share: Save:

কোথাও চায়ের বা বিভিন্ন খাবারের দোকানের আড়ালে। আবার কোথাও বাড়িতেই। চোলাই মদ তৈরি করে এ ভাবেই বিক্রি হচ্ছে শহরে। রাস্তার ধারের হোটেলের একাংশে সন্ধ্যার পর চলছে চোলাই ব্যবসা। দীর্ঘদিন ধরেই রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ ও ইটাহার ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় চোলাই মদের রমরমা কারবার বলে অভিযোগ।

নদিয়ায় বিষমদে মৃত্যুর ঘটনার পর উত্তর দিনাজপুর জেলা আবগারি দফতর ও জেলা পুলিশ বৃহস্পতিবার ন’টি থানা এলাকায় চোলাই মদের কারবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। পুলিশ সুপার সুমিত কুমার জানান, ওই অভিযান চলাকালীন কয়েক হাজার লিটার চোলাই মদ নষ্ট করা হয়েছে। এ দিন সোহারই এলাকা থেকে চোলাইয়ের কারবারের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবগারি দফতরের রায়গঞ্জের ওসি অংশুমান চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ ও ইটাহার ব্লকে চোলাই মদের কারবার রুখতে আবগারি দফতরের নিয়মিত অভিযান জারি রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে চোলাই কারবারিদের হামলার আশঙ্কায় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। বর্তমানে পুলিশের সহযোগিতায় জেলা জুড়ে অভিযান হচ্ছে।’’ মাসকয়েক আগে রায়গঞ্জ শহর এবং লাগোয়া এলাকার ধাবা এবং বেশ কিছু হোটেলগুলোয় সন্ধের পর চোলাইয়ের ব্যবসা বন্ধ করতে কড়া বার্তা দেয় পুলিশ। হোটেলে মদ বিক্রি করা হবে না বলে মালিকদের লিখিত বয়ানও দিতে হয়েছে। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর ফের সেই কারবার শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ।

পুলিশেরই একটি সূত্র জনিয়েছে, অভিযানের পর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ফের তা শুরু হয়। শহরের হোটেল, ধাবাগুলোয় চোলাই সরবরাহের লোকও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে হোটেলের কর্মীরাও এই কাজে যুক্ত। গত বছরের ডিসেম্বরে রাতে রায়গঞ্জের বামুয়া এলাকায় চোলাই মদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হামলার মুখে পড়েন আবগারি দফতরের দুই সাব ইনস্পেক্টর এবং কর্মীরা। একাধিক চা ও খাবারের দোকানে বেআইনি ভাবে চোলাই বিক্রি বন্ধ করতে অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। সেই পরিস্থিতি আজও বদলায়নি বলে অভিযোগ।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় রায়গঞ্জের ভাঙারোড এলাকায় চোলাই মদের কারবার বাড়ছে। গত বছরের নভেম্বরে ওই এলাকায় চোলাইয়ের কারবার বন্ধের দাবিতে লাঠিসোটা হাতে নিয়ে মহিলাদের একাংশের বিক্ষোভও দেখান। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগেই চোলাই মদের ঠেক ও কারখানার এত রমরমা বলে অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁরা। একই ভাবে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি হেমতাবাদের দক্ষিণ ধোয়ারই এলাকায় পাঁচটি চোলাই মদের কারখানা ও ঠেক ভাঙচুর করেন ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা।

আবগারি দফতর সূত্রের খবর, বর্তমানে রায়গঞ্জ ব্লকের সোহারই, বুধোর, কমলাবাড়ি, বীরঘই, পারধা, রামপুর, বিন্দোল ও ভাটোল এলাকায় বাসিন্দাদের একাংশের বাড়িতে চোলাই তৈরি ও বিক্রি হয় বলে অভিযোগ। সেই মদ বিহারেও পাঠানো হচ্ছে। রায়গঞ্জের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারের ধাবা ও বিভিন্ন হাটেও চোলাই মদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ইটাহার ব্লকের সরাইদিঘি, বাঙার, ও জয়হাট, হেমতাবাদ ব্লকের দক্ষিণ ধোয়ারই, সমাসপুর, বিষ্ণুপুর, চৈনগর ও বাঙালবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন এলাকায়, কালিয়াগঞ্জের রাধিকাপুর, ডালিমগাঁও, বোচাডাঙ্গা, অনন্তপুর, ধনকল ও কুনোর এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে চোলাই মদের কারখানা গজিয়ে উঠেছে। ওই চোলাইমদ এলাকার দোকান ও হাটে বিক্রি হয় বলে আবগারি দফতরের দাবি।

বালুরঘাট

দেশি ও বিদেশি মদের দাম ক্রমশ বেড়ে চলায় দক্ষিণ দিনাজপুরের মত কৃষিপ্রধান জেলায় চোলাই মদের দিকে বেশি ঝুঁকছেন অধিকাংশ লোক। পুরো জেলা তো বটেই, খোদ বালুরঘাট শহরের মধ্যে তিনটি এলাকায় চোলাই মদ তৈরির ব্যাপারটা রীতিমতো কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ।

স্থানীয় কয়েকজনের দাবি, গুড়ের তৈরি চোলাইয়ের নেশা বেশি হয়। ফলে সেখানে ভিড়ও বেশি হয়। আবার নেশার মাত্রা বাড়াতে ওই মদে কখনও কখনও মাদক বড়ি মেশানো হয়। এমনকী, ইউরিয়া সারও মেশানো হয় বলে অভিযোগ। আর এইসব করতে গিয়েই চোলাই মদে বিষক্রিযার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বলে জানালেন জেলা আবগারি সুপার শুভেন্দু শেখ। ফলে নদিয়ার মত বিষ চোলাই খেয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরেও গণমৃত্যু হাতছানি দিয়েই আছে। যে কোনও দিন ওই ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ওই আবগারি সুপার বলেন, ‘‘নেশা বাড়াতে ইউরিয়া সারের মত ওইসব সামগ্রী মেশানোর ফলে বিষ চোলাইয়ের জেরেই মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটে।’’ তবে এ জেলায় গত কয়েক বছরে চোলাই খেয়ে মৃত্যুর কোনও ঘটনা নেই বলে শুভেন্দুর দাবি। তাঁর বক্তব্য, চোলাইয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। বোল্লাকালী পুজো ও মেলায় চোলাইয়ের বিরুদ্ধে আবগারি দফতর সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে কয়েক বছর আগে বালুরঘাটের বোয়ালদার এলাকায় চোলাই মদ খেয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। পাশাপাশি, ভেজাল বিলাতি মদ খেয়ে মৃত্যু মিছিল দেখেছে বালুরঘাট।

প্রায় দু’বছর আগে অপেক্ষাকৃত সস্তার হুইস্কি ১৮০ মিলিলিটারের দাম ছিল ৬৫-৭০ টাকা। সেই ছোট বোতলের দাম এখন ১৫৫ টাকা। দেশি (বাংলা) মদের দাম প্রায় আট মাস আগে ছিল ৫৫ টাকা। এখন তার দাম ৭৫ টাকা। ফলে অল্প আয়ের মানুষ আগে যারা বাংলা মদ খেতেন। দাম বেড়ে যাওয়ার পর তারা ৪০ টাকা দামের এক বোতল চোলাই মদের দিকে বেশি ঝুঁকছেন বলে আবগারি দফতরও স্বীকার করেছে।

দু’বছর আগে বালুরঘাটের বোয়ালদারে চোলাই খেয়ে একজন মারা যান। অসুস্থ হন তিনজন। বালুরঘাটের চকভৃগু এলাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বারে গত ২০০৭ সালে ভেজাল বিলাতি মদ খেয়ে এক মহিলা সহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়। আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইথাইল স্পিরিটের বদলে মিথাইল বা মিথানল স্পিরিট মেশানো জাল মদ খেয়ে ওই ১৪ জনের মৃত্যু হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE