চার ইয়ারি কথা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই পথ চলা তুহিন, দেবাশিস, শিবেন, চিরঞ্জিতের।—নিজস্ব চিত্র
সিনেমা বা উপন্যাস নয়। এ এক বাস্তবের চার ইয়ারি কথা। অনটনের মধ্যেও মাধ্যমিকে কৃতী চার বন্ধুর কথা।
গৃহশিক্ষকের কাছে পড়বেন, এমন সামর্থ ছিল না যাদের পরিবারের। কিন্তু ওদের ছিল ইচ্ছাশক্তি আর জেদ। আর তাতেই ভর করে মাধ্যমিকে স্টার তো বটেই, প্রত্যেতেই ৮৪ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। এদের মধ্যে এক জনের প্রাপ্ত নম্বর ৯২ শতাংশ। ওই চার তারার আলোয় ঝলমল মালদহের রতুয়ার প্রত্যন্ত কৈরিটোলা গ্রাম। কৈরিটোলাই নয়, তারা যে স্কুলে পড়ত, সেই হরিপুর হাই স্কুল তো বটেই, রতুয়া জুড়েই ওই চার বন্ধুর লড়াইয়ের কাহিনি এখন চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে তুহিন মণ্ডল ৬৪৪, দেবাশিস মণ্ডল ৬০৭, শিবেন মণ্ডল ৫৯৯ ও চিরঞ্জিত মণ্ডলের প্রাপ্ত নম্বর ৫৯৪।
স্কুলে আরও ন’জন স্টার পেলেও ঘটনাক্রমে ২৫১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে চার বন্ধুর প্রাপ্ত নম্বরও ক্রমান্বয়ে সর্বোচ্চ। তবে লড়াই করে ভাল ফল করলেও আপাতত দুশ্চিন্তাও পেয়ে বসেছে তাদের। কেননা হরিপুর স্কুলে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ নেই। ফলে মালদহের কোনও স্কুলে ভর্তি হতে হবে। কী ভাবে সেই খরচ চলবে, তা নিয়েই দিশেহারা তাদের অভিভাবকরা। যদিও চার তারার পাশে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে চাঁদা তুলে ফের তাদের পড়াশোনার বন্দোবস্ত করা হবে জানিয়েছেন বাসিন্দাদের একাংশ।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত ঝা বলেন, ‘‘ওরা সব সময় একসঙ্গে থাকত। পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবত না। কোনও সমস্যা হলেই শিক্ষকদের কাছে ছুটে আসত। আমরাও যতটা পেরেছি ওদের সাহায্য করেছি, করবও।’’
স্কুল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কৈরিটোলা। ভাঙাচোরা মাটির যে রাস্তায় সাইকেল চালানোও দায়, সমস্যা এতটাই। ওই রাস্তার দাবিতে সদ্য বিধানসভা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন বাসিন্দারা। যদিও সামান্য মাটি ফেলে প্রশাসনের তরফে আশ্বাস দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত বয়কট হয়নি। তুহিনের বাবা সুবলবাবু গ্রামেরই একটি নার্সারি স্কুলের শিক্ষক। তাঁর ছেলেকে টিউশন পড়ানোর টাকা নেই। আর দেবাশিসের বাবা অসিতবাবু মহাজনদের কাছ থেকে সার নিয়ে এসে গ্রামের চাষিদের কাছে বেচে যা আয় করেন তাতে দু’বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হয়। শিবেনের বাবা শক্তিপদবাবু দিনমজুরি করেন। চিরঞ্জিতের বাবা হরিপদবাবু গ্রামীণ চিকিত্সক। সাতসকালে সাইকেল নিয়ে সন্ধে পর্যন্ত ছুটেও একেক দিন যাকে শূন্য হাতেই ঘরে ফিরতে হয়। আর বাড়ি বলতে মাটির দেওয়ালে খড়ের ছাউনি।
গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের পর হরিপুর স্কুলেও পঞ্চম শ্রেণিতে এক সঙ্গে। ক্লাস নাইনে শপথ নেয় তারা, ভাল ফল করতেই হবে। তখন থেকেই দিনে-রাতে পড়াশোনা এক সঙ্গে। একেকদিন একেকজনের বাড়িতে বসত তাদের চার ইয়ারি পাঠশালা। পড়াশোনার সঙ্গে সামান্য খাবারও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে খাওয়া। কোনও সমস্যা হলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, না মিটলে ছুট শিক্ষকের কাছে। শিক্ষকদের পাশাপাশি গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দাও বই-খাতা কিনে দিয়ে সাহায্য করতেন।
হরিপুর হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক ভবেশ কর্মকার বলেন, ‘‘প্রত্যেকেই প্রচন্ড অভাবী। কিন্তু হাল ছাড়েনি। পড়াশোনাতেই ওরা যে ভালো তাই নয়, এতটাই শান্ত ও ভদ্র যে কখনও শিক্ষকদের সঙ্গে মাথা তুলে কথা বলতে দেখিনি।’’
চার জনই চিকিত্সক হতে চায়। তুহিন, দেবাশিসরা বলে, ‘‘আমরা চার জন সব সময় একে অন্যের পাশে থেকেছি। প্রতিযোগিতা থাকলেও হিংসা ছিল না। উচ্চমাধ্যমিকেও সবাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাই। দেখি কী হয়!’’ শিক্ষক ও বাসিন্দারা অবশ্য বলছেন, ওদের চার ইয়ারি পাঠশালা ঠিক থাকলে, কার সাধ্য ওদের আটকায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy