Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই নীরব জোট সংযোজিত ওয়ার্ডে

পেশির জোরে রেলের ঠিকাদারি আদায় থেকে তেলের অবৈধ কারবারের অভিযোগ এনজেপি এলাকায় নতুন কিছু নয়। বাম আমলে যা নিয়ে আমজনতার ক্ষোভ তুঙ্গে পৌঁছেছিল। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে জনতার ধারনা ছিল পরিস্থিতি পাল্টাবে। কিন্তু, ওই অসাধু ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা শিবির বদলে তৃণমূলের ছাতার নিচে আশ্রয় নেয় বলে অভিযোগ। ফলে, শিলিগুড়ির পুরসভার সংযোজিত ওয়ার্ডগুলিতে বাসিন্দাদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

ভোটের ফলের পরে জয়দীপ নন্দী। নিজস্ব চিত্র।

ভোটের ফলের পরে জয়দীপ নন্দী। নিজস্ব চিত্র।

অনির্বাণ রায়
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৪৩
Share: Save:

পেশির জোরে রেলের ঠিকাদারি আদায় থেকে তেলের অবৈধ কারবারের অভিযোগ এনজেপি এলাকায় নতুন কিছু নয়। বাম আমলে যা নিয়ে আমজনতার ক্ষোভ তুঙ্গে পৌঁছেছিল। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে জনতার ধারনা ছিল পরিস্থিতি পাল্টাবে। কিন্তু, ওই অসাধু ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা শিবির বদলে তৃণমূলের ছাতার নিচে আশ্রয় নেয় বলে অভিযোগ। ফলে, শিলিগুড়ির পুরসভার সংযোজিত ওয়ার্ডগুলিতে বাসিন্দাদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

তার উপর এ বারের পুরভোটেও ‘বহিরাগত’দের জড়ো করা, রাতে বাইক বাহিনী নিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা, যথেচ্ছ মদ ও টাকা বিলির অভিযোগ তোলে বামেরা। এনজেপি স্টেশন লাগোয়া কয়েকটি ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘হাড়-হিম’ করা সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। বেশ কিছু ওয়ার্ডের বস্তি এলাকায় বাড়ি বাড়ি প্রচার চালানোর সময়ে কর্মীদের দু-এক জন পকেটে ‘পাইপগান’ গুঁজে রেখেছিল বলে অভিযোগ তুলেছিল বামেরা।

মঙ্গলবার পুরভোটের ফল প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছে, সংযোজিত ১৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮টি দখলে গিয়েছে বামেদের। নিউজলপাইগুড়ি লাগোয়া ৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তিনটিতেই জয়ী হয়েছে বাম প্রার্থীরা। বামেদের দাবি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘চুপচাপ’ জোট হয়েছিল বাসিন্দাদের। অন্যদিকে তৃণমূলের বক্তব্য, মানুষ কেন মুখ ফেরাল তা বিশ্লেষণ করতে হবে।

বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘যে সব এলাকাতে দাদাদের নামিয়ে ভোটের বহু আগে থেকেই তৃণমূল আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল। সেই ওয়ার্ডগুলিতে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে মানুষ তৃণমূলের বিরোধিতা করেছে। সে কারণেই একের পর এক সংযোজিত ওয়ার্ডে আমরা জয় পেয়েছি।’’

ঘটনা হল, গত লোকসভা ভোটের নিরিখে সংযোজিত ওয়ার্ডের ১৪টির মধ্যে বামেরা একটি মাত্র ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে তৃণমূল এগিয়ে ছিল সাতটিতে। নিউ জলপাইগুড়ি লাগোয়া চারটির মধ্যে তিনটিতেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। এবারের পুরভোটের ফল নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই নানা প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত হয়েছেন জয়দীপ নন্দী। ভোটের আগে থেকেই জয়দীপবাবুর বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তোলেন বামেরা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের অটোচালক, শ্রমিকদের হুমকি দিয়ে মিছিলেন সামিল করার অভিযোগ ওঠে। মিছিলে আসা নিশ্চিত করতে সকলের হাতে ‘টোকেন’ও ধরানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। মিছিলে গিয়ে টোকেন জমা দেওয়ার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। টোকেন জমা না পড়লে টানা পাঁচ দিন গাড়ি চালানো বা কাজে যোগ দিতে না দেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

শুধু প্রচারের সময় হুমকি নয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে নিউ জলপাইগুড়ি এলাকায় দাদাগিরি চালিয়ে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের নিজেদের দিকে টানার অভিযোগ ওঠে। একশ্রেণির ব্যবসায়ীর কাছে নিয়মিত তোলাবাজি শুরু হয় বলেও অভিযোগ। এলাকায় বাড়ি বা জমি বিক্রিতেও ‘সিন্ডিকেট রাজ’ গজিয়ে ওঠার অভিযোগ ওঠে। শাসক দলের ছত্রছায়া থাকা ‘দাদা’দের ‘সম্মতি’ না নিয়ে কোনও জমি কেনা-বেচা অথবা প্রমোটারি ব্যবসা করা সম্ভব নয় বলে অভিযোগ। রেলের বিভিন্ন টেন্ডারে অংশ নিতে হলেও ওই দাদাদের ‘ছাড়পত্র’ অপরিহার্য বলে অভিযোগ ওঠে।

অশোকবাবুদের দাবি, বছর ভর নানা হুমকি-চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয়েছে বাসিন্দাদের। তার সঙ্গে পুরভোটের প্রচারের সময়েও নতুন করে হুমকি-সন্ত্রাস শুরু হওয়ায় বাসিন্দারা নিজেরাই প্রতিরোধ করেছেন। শাসক দলের মিছিল-সভাতে গেলেও অনেকেই পুরভোটের ইভিএমে বাম প্রার্থীদের সমর্থনেই বোতাম টিপেছেন বলে দাবি। সংযোজিত ওয়ার্ডে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘চুপচাপ’ এই ভোটের প্রবণতা তৃণমূল নেতার বুঝতে পারেনি বলে দাবি করেছে বামেরা।

তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলর জয়দীপবাবু বলেন, ‘‘সন্ত্রাস করলে তো আমরাই জিততাম। শিলিগুড়িতে এ সব চলে না। বামেরা মিথ্যে অভিযোগ তুলে বদনাম করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মানুষ কেন মুখ ফিরিয়ে নিল সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে।’’ এ দিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দার্জিলিং জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌতম দেব অবশ্য অশোকবাবুদের রাজনৈতিক আক্রমণের উত্তর দিতে চাননি। এ দিন গণনা কেন্দ্রের সামনে তৃণমূলের অস্থায়ী বুথ অফিসে বসে গৌতমবাবু বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক আক্রমণের উত্তর দিতে চাই না। বিরোধীরা রামধনু জোট করেছিল। তবে আমরা হারের কারণ বিশ্লেষণ করব।’’

তবে এ দিন গণনা চলাকালীন সংযোজিত ওয়ার্ডের ফলের প্রবণতা টের পেয়ে তৃণমূলের কর্ম-সমর্থকদের একাংশও ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘‘পাইপগান দেখিয়ে ভোট হয় না। অসাধু উপায়ে ধনী হয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগের জন্য কারা মরিয়া সেটা মানুষ বোঝেন। তা ছাড়া শুধু টাকা পয়সা বিলি করে যে সব সময়ে ভোটে জেতা যায় না সেটা সব দলকে বুঝতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE