কুলিক থেকে সুকনায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিতাবাঘটিকে। নিজস্ব চিত্র
সোমবার এই ঘরেই ‘বিপ্লব’ ঘটে গিয়েছে। ঘটন অঘটন পটিয়ান যিনি ঘরটিতে ক্ষণিকের ‘অতিথি’ হয়েছিলেন, তাঁর পদচিহ্নই আরও আতঙ্কিত করে রেখেছে ঘরের মালিক বিপ্লব দাস ও তাঁর পরিবারের সকলকে। তাই সোমবার রাতটা তাঁরা ঘরদোর ছেড়ে সামান্য দূরে পড়শির বাড়িতে কাটালেন।
মঙ্গলবারও বারবার বিপ্লববাবুদের কথায় ঘুরে আসছিল ‘বাঘ বাহাদুরের’ কথা। সোমবার রায়গঞ্জ মাতিয়ে দেওয়া চিতাবাঘটিকে ওই নামেই ডাকছেন কেউ কেউ। বিপ্লব বলছিলেন, সকালেই তাঁরা খবর পান, এলাকায় চিতাবাঘটি ঘোরাফেরা করছে। ‘‘বাড়িতে দুটো বাচ্চা রয়েছে। আমার দুই যমজ ভাগ্নী বেড়াতে এসেছে। সাড়ে সাত বছর বয়েস তাদের। তা ছাড়া স্ত্রী আর প্রৌঢ়া মা তো আছেনই। কখন কী বিপদ ঘটবে! তাই সকালেই ওদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাই,’’ বললেন বিপ্লব।
পাকা দেওয়াল, টিনের চাল, ছোট সাধারণ বাড়ি বিপ্লবের। দরজা ভেজানো রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। বিকেলে লোকের তাড়া খেয়ে সেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে চিতাবাঘটি। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় হুড়কো টেনে তাকে ‘বন্দি’ করে ফেলা হয়। এই ঘরেই তাকে মুরগি খেতে দেওয়া হয়। তার পরে ঘায়েল করা হয় ঘুমপাড়ানি গুলি মেরে।
এই মুহূর্তে গোটা এলাকায় বিপ্লববাবুর এই ঘরটি নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। অনেকেই ঘরটা দেখতে আসছেন। আর বিপ্লববাবুর কাছে গল্প শুনছেন। জানতে পারছেন, রাতে আর এই বাড়িতে থাকার সাহসই করেননি বিপ্লববাবুরা। কিন্তু কেন? আর তো বাঘের ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল না। তা হলে?
‘‘থাকব কী করে? ঘরে তো বাঘের গায়ের গন্ধ!’’ বললেন বিপ্লব। জানালেন, যেটুকু সময়ে চিতাবাঘটা ঘরের মধ্যে ছিল, সব কিছু লন্ডভন্ড করেছে। দাঁত-নখে বিছানা ছিঁড়েছে। উল্টে দিয়েছে চেয়ার-টেবিল। ‘‘এ সবের মধ্যে গিয়ে কি রাত কাটানো যায়?’’
এর সঙ্গে রয়েছে চিতাবাঘের ফেলে যাওয়া আতঙ্কের ছাপ। দিনভর এই আতঙ্ক নিয়েই বাড়ির বাইরে কাটিয়েছেন বিপ্লবরা। রাতে ওই ঘরে ঢুকতে সেই আতঙ্কই যেন চেপে বসতে চাইছিল।
আতঙ্ক যে রায়গঞ্জকে ছাড়েনি, সেটা বোঝা গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা। যেখান থেকে সোমবার চিতাবাঘটিকে ধরা হয়েছে, সেই ইন্দিরা কলোনির খুব কাছেই রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতাল। এ দিন সন্ধ্যায় তার মর্গের কাছে জলার ধারে জঞ্জালের স্তূপের মধ্যে কয়েক জন আবার বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পান বলে খবর রটে যায়। যদিও আদৌ সেই পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছেই। কারণ, এই জলা আর জঞ্জালের মধ্যে এত রাতে পায়ের ছাপ ভাল করে ঠাওর করাই কঠিন। কিন্তু গুজবের ঠেলায় রাত সাড়ে ন’টার পর থেকে রায়গঞ্জের অনেকে এলাকাতেই লোকজন রাস্তায় ভিড় করেন। আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শহর জুড়ে।
আরও একটা প্রশ্ন এ দিনও রায়গঞ্জের হাওয়ায় ঘুরে বেড়ালো। তা হচ্ছে— এই শহরে চিতাবাঘটি এলো কী ভাবে? শহরের কাছে এমন কোনও বনাঞ্চল বা চা বাগান নেই, যেখান থেকে চিতাবাঘটি চলে আসবে। বিহারের বারসই বা ঠাকুরগঞ্জ বনাঞ্চল থেকে আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন বনকর্তাদের একাংশ। আর একটি অংশের ধারণা, পাচারের সময়ে বাঘটি কোনও রকমে পাচারকারীদের হাত ছাড়িয়ে চলে এসেছিল।
পাচারের এই তত্ত্ব অবশ্য খোদ বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মণ এবং উত্তরবঙ্গের বনপাল (বন্যপ্রাণ) সুমিতা ঘটক উড়িয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, “রায়গঞ্জের ওই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। ওই এলাকায় আগে এমনটা সে ভাবে হয়নি।” বনপালের বক্তব্য, “পাচারের পথে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি বাস্তব সম্মত মনে হচ্ছে না। ছোট চা বাগানেও চিতাবাঘের ডেরা থাকে। উত্তর দিনাজপুর জেলায় কিছু চা বাগান গড়ে উঠেছে। কাছে বিহারও রয়েছে। সবটাই দেখা হচ্ছে।” ঠিক কী ভাবে এবং কোথা থেকে চিতাবাঘটি রায়গঞ্জ শহরে পৌঁছল, তা নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন বনমন্ত্রী।
তদন্তের প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে বলছে পশুপ্রেমী সংগঠনগুলি। তাদের প্রশ্ন, সুকনা থেকে রায়গঞ্জ মোটে ২০০ কিলোমিটার। তা হলে মহানন্দা বন্যপ্রাণ বিভাগের কর্মীদের কেন ১১ ঘণ্টা লেগে গেল? প্রশ্ন উঠেছে রায়গঞ্জে বন্যজন্তু ধরার পরিকাঠামো না থাকা নিয়েও। উত্তর দিনাজপুরের ডিএফও দ্বীপর্ণ দত্তও জানান, ‘‘ভবিষ্যতে বন্যজন্তুদের বাগে আনতে ও তাদের চিকিত্সা পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy