Advertisement
০৭ মে ২০২৪

নেহাই ভরসা ছিল নাগাসিয়া দম্পতির

সকালে রুটি-সব্জি খেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবা-র কাছে বায়না ধরেছিল চোদ্দ বছরের নেহা। বাসে করে দুইবেলা আসা যাওয়া, দিনভর স্কুলের পর মেয়ে যাতে দুর্বল না হয়, তাই জোর করে পেট ভরে নেহাকে শাক, সব্জি দিয়ে ভাত খাওয়ান আকবর নাগাসিয়া।

উল্টে পড়ে রয়েছে নেহাদের বাসটি। —নিজস্ব চিত্র।

উল্টে পড়ে রয়েছে নেহাদের বাসটি। —নিজস্ব চিত্র।

কৌশিক চৌধুরী
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:১৪
Share: Save:

সকালে রুটি-সব্জি খেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবা-র কাছে বায়না ধরেছিল চোদ্দ বছরের নেহা। বাসে করে দুইবেলা আসা যাওয়া, দিনভর স্কুলের পর মেয়ে যাতে দুর্বল না হয়, তাই জোর করে পেট ভরে নেহাকে শাক, সব্জি দিয়ে ভাত খাওয়ান আকবর নাগাসিয়া। কিন্তু মেয়েকে শেষবার ইচ্ছামতন খেতেও দিলেন না বলে মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাগানের ছোট্ট শ্রমিক মহল্লার ঘরের সামনে বসে কেঁদেই চলছিলেন আকবর।

তরাই-এর বহু পুরানো চা বাগান তাইপু চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক আকবর। স্ত্রী মুনমুন বাগানেরই অস্থায়ী শ্রমিক। মেয়ে নেহা আর সাত বছরের ছেলে আনন্দকে নিয়ে সাজানো সংসার। আনন্দের ছোট থেকেই চোখের সমস্যা। রাতদিন কাজ করে মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো আর ছেলেকে সুস্থ করাই লক্ষ্য ছিল নাগাসিয়া দম্পতির। বৃহস্পতিবার সকালের হাঁসখোয়া ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে বেসরকারি বাসটি উল্টে যেতেই রাতারাতি হারিয়ে গেল নাগাসিয়া দম্পতির স্বপ্নের, অনেকটাই। ওই বাস দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে নেহা।

আকবর কাঁদাতে কাঁদতে বলেন, ‘‘মেয়েটাকে শেষবারের মতো নিজের ইচ্ছা মতো রুটি খেতেও দিলাম না। নিজে রুটি খেয়ে জোর করে ভাত খাওয়ালাম। আর কোনওদিন রুটিতে হয়তো হাতই দিতে পারব না। আমার সমস্ত স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল।’’ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বিড়বিড় করে জানান, লেখাপড়া ঠিকঠাক জানেন না। মেয়েটা পড়তে চেয়েছিল। বড় হয়ে বাগানের স্কুলে পড়াবে বলত। বললেন, ‘‘ভাইয়ের চিকিৎসা জন্য ওকে বড় হতে হবে বলত। সব আমার হারিয়ে গেল।’’

বাইক আরোহীকে কাটাতে গিয়ে বাসটি উল্টে যেতে মাথায়, বুকে চোট পেয়ে নেহা মারা বলে চিকিৎসকেরা জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকা থেকে খবর পৌঁছায় হাঁসখোয়া লাগোয়া তাইপু চা বাগানে। এরই ছোট্ট শ্রমিক মহল্লায় আকবরের টিনের বাড়ি। নেহা স্কুল থেকে ফিরলে ভাইবোনে বিকালে খেলাটা ছিল রোজকার রুটিন। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই দিদির খোঁজ শুরু করে আনন্দ। বাড়িতে কান্নার রোল পড়তেই কিছু আঁচ করেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে আনন্দ। মা মুনমুনদেবী ঘনঘন জ্ঞান হারান। বিকালে মেডিক্যাল কলেজ থেকে দেহ বাগানে পৌঁছাতেই নেমে আসে শোকের ছায়া।

মৃত ছাত্রীর আত্মীয়, সম্পর্কে কাকা সঞ্জয় বরাইক জানান, নেহা খুবই হাসিখুশি ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত, বড়ও হচ্ছিল। কিন্তু এখনও দেখলে ছোট্ট শিশুর মত নানা আবদার করত। দৌঁড়ঝাপ করে মহল্লা কাপিয়ে রাখত। সবার ঘরে ঢুকে খোঁজখবর নিত। ওর ভাইয়ের চোখের সমস্যা। বড় হয়ে রোজগার করে ভাইয়ে সুস্থ করা কথা খালি বলত। সকালেই মেয়ে হাসতে হাসতে স্কুল গেল। এ ভাবে ওর নিথর দেহ আমাদের নিয়ে আসতে হবে, কোনও দিন ভাবিনি। হাঁসখোয়া থেকে নেহার সঙ্গে বাসে উঠেছিল একই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আর্য নাগাসিয়া। পায়ে চোট রয়েছে আর্য’র। তার কথায়, ‘‘আমি উঁচু ক্লাসে পড়ি বলে নেহা নানা বিষয়ে সাহায্য চাইত। খেলাধূলাও করেছি। প্রায়ই একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। আর ও যাবে না ভাবলেই গায়ে কাটা দিচ্ছে।’’

মেডিক্যাল কলেজে নাগাসিয়া পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে এসেছেন তৃণমূল নেতা মদন ভট্টাচার্য। তিনি জানান, নেহার বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। ছেলেটার চোখের যাতে ঠিকঠাক চিকিৎসা হয় অবশ্যই দেখব। তাইপু চা বাগানে তৃণমূলের চা শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নির্জল দে বলেন, ‘‘এখন বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলি ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো করিয়ে বড় করানোর চেষ্টা করে। নেহা ওই পরিবারটির আগামী দিনের ভরসা ছিল। পরিবারটির পাশে থাকব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Neha Nagasia Couple Accident Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE