সিঙ্গুর রায় ঘোষণার পরে শিলিগুড়িতে তৃণমূলের কংগ্রেসের মিছিল।
কয়েক ঘণ্টার জন্য স্মৃতির চাদরে যেন মুড়ি দিয়েছিল উত্তরের পাহাড় ও সমতলের বিস্তীর্ণ এলাকার রাজনীতি। সিঙ্গুর-মামলার রায় শোনার পরে উত্তরবঙ্গের নেতা-মন্ত্রী-জন প্রতিনিধিদের একটা বড় অংশের প্রতিক্রিয়ার ছবিটা অন্তত সে কথাই বলে।
এক মন্ত্রী পদমর্যাদা, নিজের চেয়ার-টেয়ার ভুলে লাফিয়ে উঠে জয়ধ্বনি দিয়েছেন। নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে বসে টিভিতে রায় শোনার পরে তাঁর শিশুর মতো উচ্ছ্বাস দেখেছেন সহকর্মীরা। আবার শিলিগুড়িতে হিলকার্ট রোড লাগোয়া চেম্বারে বসে রায় শোনার পরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা দার্জিলিং জেলার নেত্রী জোৎস্না অগ্রবাল। পেশায় আয়কর আইনজীবী জোৎস্নাদেবীর স্মৃতিতে বারেবারেই ঘুরে ফিরে এসেছে সেই অনশনের কাহিনি। আর সে কথা বলতে গিয়ে বারবার ওড়নায় চোখ মুছছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘অনশনের সময়ে নেত্রীর চেহারা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। আজ, রায় শোনার পরেও চোখে জল আসছে সেই পুরনো কথা ভেবে।’’
জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীও স্মৃতিকাতর। তিনি ছাত্র পরিষদের নেতা থাকার সময়েই তৃণমূল নেত্রী সিঙ্গুর আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। কলেজ স্ট্রিটের মিছিল, সেখানে গ্রেফতার হওয়া, সিঙ্গুরে গিয়ে ১৪৪ ধারার মধ্যে পড়ে ফিরতে বাধ্য হওয়া, সবই ছবির মতো ভাসে তাঁর চোখে। বর্তমানে এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান সৌরভবাবুর কথায়, ‘‘কী দিন গিয়েছে ভাবা যায়! তবে আজ খুশির দিন।’’ তবে সৌরভবাবুর মনে ছোট একটা খটকা রয়েছে— বাম আমলে এসজেডিএ শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে জমি অধিগ্রহণের পরে অনিচ্ছুকদের হয়ে তৃণমূল আন্দোলন করেছিল। তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেও সেই জমি এখনও এসজেডিএ পুরোপুরি ফেরাতে পারেনি অনিচ্ছুকদের কাছে। ফলে, সিঙ্গুর রায়ের পরে এই নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হলে কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটা এখনই ভাবতে হচ্ছে সৌরভবাবুকে।
এখন বিরোধী শিবিরের নেতা হলেও শিলিগুড়ির কংগ্রেস কাউন্সিলর সুজয় ঘটক সিঙ্গুর আন্দোলনের গোড়া থেকেই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ছায়াসঙ্গী ছিলেন। বললেন, ‘‘প্রিয়দার হাত ধরেই সিঙ্গুরে একাধিকবার যাতায়াত করেছি। শিলিগুড়িতেও তা নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছি। আজ, বারবার প্রিয়দার কথাই মনে পড়ছে। উনি সুস্থ থাকলে বিষয়টা ভিন্ন মাত্রা নিত।’’
মিছিলে বাজনা নিয়ে উল্লাস তৃণমূলের সমর্থকদের।
দুপুর পর্যন্ত শিলিগুড়ি পুরসভায় হট্টগোল করলেও তৃণমূলের কাউন্সিলরদের অনেকের চোখ নজর ছিল সিঙ্গুর মামলার দিকে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কৃষ্ণ পাল ঘনঘন এসএমএস করে মামলার রায় জানতে চাইছিলেন। বিকেলে রায় জানতেই, স্কুলে ম্যাচ জেতার আনন্দের পরে যে ভাবে খেলায়োড়রা লাফিয়ে ওঠে, সে ভাবে হইচই বাঁধিয়েছেন। কৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘সিঙ্গুর নিয়ে আইন অমান্য করে আমাদের কত জন যে গ্রেফতার হয়েছে, তার হিসেব নেই। হিলকার্ট রোডে আমিই একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছি।’’
উদ্বেল ডুয়ার্সের ফালাকাটাও। সিঙ্গুরের বিক্ষোভে পুলিশের লাঠি চালানোর প্রতিবাদে একটি জনসভার আয়োজন হয়েছিল ফালাকাটার চৌপথীতে। তৎকালীন ব্লক তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, সভার জন্য প্রশাসনের অনুমতি চাইতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল। তাঁর নাম-ঠিকানা সব লিখে রাখা হয়েছিল। পাল্টা হুমকি দিয়ে তিনি দাবি করেছিলেন, সভা সেখানেই হবে, গ্রেফতার হতেও তাঁর দ্বিধা নেই। আজও সেই ব্লক সভাপতির মনে আছে, বছর তিনেক পরে শুধু কৌতূহলবশত সিঙ্গুরে গিয়েছিলেন। তখনও জানতেন না, সিঙ্গুরই রাজ্যের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবেন। সেই ব্লক সম্পাদক আজ পরপর দু’বারের বিধায়ক, অনিল অধিকারী। বললেন, ‘‘সিঙ্গুর যখন উত্তাল আমরা উত্তরবঙ্গেও আন্দোলন সংগঠিত করেছিলাম। হুমকি, বাধা তো ছিলই। যাঁরা সভায় আসতেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের ভয় দেখানো হতো।’’
কোচবিহারের তৃণমূল নেতা মিহির গোস্বামীর কাছে সিঙ্গুর মানে দিনভর হুগলির সেই গ্রামে ঘোরা, বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলা। দূর দূরান্ত থেকে আসা আন্দোলনকারীদের খিচুড়ি পরিবেশন করা। কোচবিহার থেকে সরাসরি ‘দিদি’র অবস্থান মঞ্চে পৌঁছে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিহিরবাবু। তিন দিন ছিলেন অবস্থান মঞ্চে। মিহিরবাবু বলেন, ‘‘তখন সারা রাজ্য থেকে কর্মী-সমর্থকরা জড়ো হয়েছিলেন সিঙ্গুরে। টাকা-পয়সাও ছিল না। তাই ঢালাও খিচুড়ি রান্না হতো। বালতি হাতে তুলে কর্মী সমর্থকদের খিচুড়ি পরিবেশন করেছি।’’ এ বারে বিধানসভায় জিতে মিহিরবাবু বিধায়ক হয়েছেন। এনবিএসটিসির চেয়ারম্যানও। মিহিরবাবু বলেন, ‘‘কোচবিহারে টানা আন্দোলন করেছি। কিন্তু ওই যে তিন দিন দিদির অবস্থান মঞ্চে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেটাই আমার কাছে প্রাপ্তি।’’
সিঙ্গুর মামলার রায়ের রেশ পড়েছে কালিম্পঙেও। কালিম্পঙের জন আন্দোলন পার্টির নেতা হরকাবাহাদুর ছেত্রী সিঙ্গুর-আন্দোলনের সময় থেকেই তৃণমূল নেত্রীর পাশে। রায় শোনার পরে উচ্ছ্বসিত হরকা বললেন, ‘‘সত্যের জয় হবেই। এটা আবার প্রমাণ হল।’’
ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy