মুখে হাসি নেই বন্ধ বাগানের খুদেদের। ছবি: রাজকুমার মোদক।
সঞ্জিত, টাপু, সঙ্গীতারা বেজায় খুশি। আবার দুর্গাপুজো এল। বছরে বার বার পুজো এলে আরও খুশি হত তাঁরা। নতুন জামা-প্যান্ট পাবে। বইপত্র ফেলে ক’দিন চলবে হইহুল্লোড়। কিন্তু বার বার যে এক সুরে জীবন চলে না, সেটা বুঝবার বোধবুদ্ধি এখনও হয়নি ওই খুদেদের।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মুনিয়া দৌড়ে এসে মা’কে বলে, ‘‘কী সুন্দর জামা এনেছে নুরজাহান! আমারটা কবে আনবে? গতবছরও নতুন জামা দাওনি।’’ মা অঞ্জলী তামাঙ্গ মেয়ের কথা শুনে অনেকক্ষণ উদাস হয়ে থেকে বলে, ‘‘তাতে তোর কী? পুজোর সময় ঘরেই থাকবি! তোর কি বাবা আছে?’’ মা-র কথা শুনে মুনিয়ার মুখের আলো দপ করে নিভে যায়। তার কয়েক ফোঁটা চোখের জলেও অঞ্জলিদেবীর কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না।
ডুয়ার্সের বন্ধ রেডব্যাঙ্ক চা বাগানে জীবন এমনই। পাঁচ বছর ধরে বাগান বন্ধ। দু’বছর আগে আগে রোগে ভু্গে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন অঞ্জলীর স্বামী। বাগান বন্ধ থাকলেও ডায়না নদীতে বালি-পাথর তুলে কোন রকমে তিন সন্তান নিয়ে চলছিলেন অঞ্জলিদেবী। এ বার গত তিন মাস সেটাও বন্ধ ছিল। কাজ না থাকায় আধ পেটা খেয়ে চলছিল অঞ্জলিদেবীর সংসার। সম্প্রতি বালি-পাথর তোলা শুরু হলেও তিন মাসের ধার দেনা শোধ করতেই চলে যাচ্ছে টাকা। স্বামী বাগানের শ্রমিক ছিলেন। বন্ধ বাগান হিসাবে ভাতার টাকাও অঞ্জলীদেবী পান না। একশো দিনের কাজ করলেও ছ’মাস-এক বছরে মজুরি পাওয়া যায়না। তাই সন্তানদের মুখে পুজোয় নতুন জামা-কাপড়ের কথা শুনলেই উদাস হয়ে যায় বন্ধ রেডব্যাঙ্কের শ্রমিক পরিবারের বাবা-মায়েদের মন। গত বছর তবু নানা সংস্থা থেকে শিশুদের কিছু জামা-কাপড় মিলেছে। কিন্তু সবার ভাগ্যে তাও মেলেনি।
বন্ধ বাগানের পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা ও বাগান কর্মী সুশীল সরকার বলেন, “বাগান বন্ধ হওয়ার পর থেকে ছোট করে কোনও রকম পুজোটা করতাম। কিন্তু, এবার কী করে পুজো হবে তা নিয়ে এখনও শ্রমিকদের সঙ্গে বসতেই পারলাম না। গত দু’বছর তবুও ধূপগুড়ির বিডিও শুভঙ্কর রায় নিজে এসে পুজো করার জন্য ভাল রকমের সাহায্য করতেন। তিনি এখন নেই। নতুন বিডিও-র কাছে গিয়ে ছিলাম। তাঁর সঙ্গেও দেখা হয়নি। পুজোটা শেষ পর্যন্ত করতে পারব কি না এখনও বলতে পারছি না।” ধূপগুড়ির বিডিও দীপঙ্কর রায় বলেন, “আগের বিডিও কী করেছেন জানা নেই। এ বার রেডব্যাঙ্ক চা বাগান থেকে কেউ এখনও যোগাযোগ করেনি। বাগানের কেউ সাহায্যর জন্যে এলে কাগজপত্র দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
রেডব্যাঙ্কের অঞ্জলী তামাঙ্গ একা নন, মেজাজ ভাল নেই ডানকানের কার্যত পরিত্যক্ত বীরপাড়া চা বাগানের বিন্দু চিকবরাইক, হান্টাপাড়া চা বাগানের চান্দু খারিয়াদের। আশ্বিন এলেও পুজো আসেনি ঢেকলাপাড়া চা বাগানের নেপানিয়া কামিন মুন্ডা, বন্ধ জয়বীরপাড়া চা বাগানের বড়া লাইনের সুশীলা তাঁতিদের জীবনে। বীরপাড়া চা বাগানের সিটুর শ্রমিক নেতা বুধুয়া লাকরা বা আদিবাসী নেতা রবিনসন কুজুরেরা বলছেন, “আগে বীরপাড়া চৌপথির মজদুর ক্লাবের পুজোয় চা বাগানের মালিক-শ্রমিকদের টাকার একটা বড় অংশ থাকত। পুজো কমিটিতেও থাকতাম বাগানের বেশ কয়েকজন। গত বছর থেকে মালিক না থাকায় শ্রমিক বা আমরাও চাঁদা দিতে পারি না। তাও বা দু’টাকা দরে চাল পাচ্ছিলাম। কেন্দ্র অধিগ্রহণ করার পর সেটাও পাই না।”
সবারই এক জবাব, হাতে কোনও কাজ নেই বছরভর। সন্তানদের পুজোয় কী দিয়ে সান্ত্বনা দেব? যতদিন বাগান চালু না হবে ততদিন আমাদের জীবনে পুজো আসবে না। পুজোর হাওয়া তাই কাশবনে দোলা দেয়। শ্রমিক লাইনের ভাঙা ঘরে ঢুকতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy