পুলিশ-নিরাপত্তা রক্ষীরা যাঁদের আটকে দিয়েছিলেন উত্তরকন্যার গেটে, তাঁদের ডেকে নিয়ে দফতরে বসিয়ে সমস্যার কথা শুনলেন সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। যা দেখে উত্তরের মানুষের ধারণা, শুরু থেকেই চালিয়ে খেলে ইনিংস শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু কোচবিহারে আটকে না থেকে এ বার তিনি সকলের নেতা হয়ে উঠছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গের সচিবালয় ‘উত্তরকন্যা’য় উপস্থিত কয়েকশো মানুষ। শুধু তাই নয়, যে সমস্যা নিয়ে ওই দর্শনার্থীরা এসেছিলেন, তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রশাসনিক অফিসারদের নির্দেশও দিলেন তিনি। রবিবাবু এটাও বলে দিলেন, আগামী দিনে কেউ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কিংবা অন্য কোনও সমস্যার ব্যাপারে চিঠি দিতে চাইলে তাঁদের যেন গেটে আটকে না দেওয়া হয়। মন্ত্রীরা কেউ না থাকলেও যেন চিঠি জমা নিয়ে সিলমোহর দেওয়া হয়, সেটাও খেয়াল রাখার জন্য সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরকন্যা মানুষের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এখানেই মানুষেরই অগ্রাধিকার। সেটা সকলকেই মাথায় রেখে চলতে হবে। সমস্যা নিয়ে ছুটে আসা কাউকে গেটে আটকে দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ ভবিষ্যতে শুনতে চাই না।’’
এখানেই শেষ নয়, উত্তরকন্যা থেকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর, দুটি জায়গায় বৈঠকেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রথম দিনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, এলাকার মানুষের চাহিদা পূরণই তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। যেমন উত্তরকন্যায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন, সেখানে অন্যান্য যে সব দফতর জায়গা পায়নি, তাঁদের কত দিনের মধ্যে ঘর দেওয়া যেতে পারে। উত্তরকন্যায় রোজ কত জন যান, তার স্পষ্ট তথ্য-পরিসংখ্যান রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যাঁরা নানা কাজে যাচ্ছেন, তাঁদের সমস্যা সমাধান না হলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাও খোঁজ নিয়েছেন তিনি। তাঁর বার্তা, সব কাজ রাতারাতি হবে না। কিন্তু তা বলে কাউকে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা যে চলবে না, সেটাও মনে রাখতে হবে অফিসারদের। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর গড়ে মুখ্যমন্ত্রী উত্তরে কাজের জোয়ার আনিয়েছেন। গৌতম দেব সে কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করেছেন। এ বার সে পথে হেঁটে আরও গতি আনাটাই আমার ও বাচ্চুর লক্ষ্য।’’
ঘটনা হল, এ দিন আগাগোড়া বাচ্চুবাবুকে পাশে রেখেছেন রবিবাবু। গোড়া থেকেই নিজের পাশে রেখে আলাপ করিয়েছেন অন্যদের সঙ্গে। কেউ তাঁকে ফুল দিতে গেলে বাচ্চুবাবুকেও দেখিয়ে ফুল দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী বাচ্চুবাবুও অভিভূত। তিনি বলেছেন, ‘‘আশা করছি, খুব ভাল করে কাজ করতে পারব। আগের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর সহযোগিতাও আমরা পাব।’’
বস্তুত, রবীন্দ্রনাথবাবু বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ যখন উত্তরকন্যায় পৌঁছন, সে সময়েই গেটের কাছে ভিড় উপচে পড়ে। সেখানেই ছিলেন ফুলবাড়ি ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব ধনতলা গ্রামের বাসিন্দা সরিফুল ইসলাম সহ জনা পঁচিশেক যুবক ও মধ্যবয়সী। তাঁদের আর্জি, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে সমস্যার ব্যাপারে জানাবেন। দেখা করতে না দেওয়া হলেও স্রেফ ভিতরে ঢুকে চিঠি জমা দেওয়াই ছিল তঁদের উদ্দেশ্য। কিন্তু, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীরা গেটে শরিফুলদের আটকে জানিয়ে দেন, মন্ত্রী বড়ই ব্যস্ত, তাই দেখা হওয়ার প্রশ্নই নেই।
এতেই ভেঙে পড়েন শরিফুল, মিজানূর, আজাদের মতো যুবকেরা। কেউ কলমিস্ত্রি, কেউ মোজাইকের কাজ করেন, কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ রংমিস্ত্রি। দু’দিন আগে ওঁদের ভিটে ছাড়ার জন্য কেউ নির্দেশ দেওয়া হয়। তাতেই ওঁরা ঘাবড়ে গিয়েছেন। ওঁদের বক্তব্য, প্রায় ২৫ বছর ধরে ওঁরা যে জমিতে রয়েছেন, সেখান থেকে হঠাৎ করে কেউ তুলে দিতে চাইলে ঘর সংসার ভেসে যাবে। ওঁদের অভিযোগ, জমির মালিককে ওঁরা নানা পর্যায়ে টাকা দিলেও নথিপত্র পাননি। যদিও জমির মালিকপক্ষ তা মানতে নারাজ। মালিকপক্ষের দাবি, ওই জমির মালিকানার নথিপত্র তাঁদের রয়েছে। এতেই রাতের ঘুম উবে যায় শরিফুলদের।
ঘটনাচক্রে, ওই সব কটি পরিবার তৃণমূলের সমর্থক বলেই পরিচিত। এলাকার নেতাদের কাছেও দরবার করেছেন ওঁরা। তখনই জানতে পারেন, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথবাবু উত্তরকন্যায় যাবেন। তড়িঘড়ি করে সকলে সেখানে যান। কিন্তু, ঢুকতে না পেরে মাথায় হাত পড়ে শরিফুলদের। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুখে-মুখে সে খবর পৌঁছে যায় রবীন্দ্রনাথবাবুর কাছেও। তিনি সরকারি বৈঠক মাঝপথে থামিয়ে অফিসারদের নির্দেশ দেন, গেটের বাইরে বসে থাকা দর্শনার্থীদের ভিতরে নিয়ে আসতে হবে। পরে রবীন্দ্রনাথবাবুর নির্দেশে জলপাইগুড়ির ভূমিসংস্কার দফতর বিষয়টি নিয়ে আজ, শুক্রবার বিশদে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তাই রাতে শরিফুলরা বলেন, ‘‘আচমকা ভিটেমাটি ছাড়তে বললে কী বিপদ হয়, সেটা সকলে বুঝবেন না। তাই ছুটে এসেছিলাম উত্তরকন্যায়। এত সমাদর পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy