খেতের ফসল বিক্রির লাভের অঙ্ক গিলে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। গ্রামের বাজারে দর নেই। ফসল গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে যেতে হয়ে যে খরচ হয় তাতে লাভ কমে, শহরে পৌঁছলেও ফসল বিক্রি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাধ্য হয়েই গ্রামে ফসল কিনতে আসা দু একজন ‘চেনা’ মুখ ছাড়া উপায় নেই। এই চেনা মুখের সিন্ডিকেট ফসলের দামও বেশি দিতে চায় না বলে অভিযোগ।
কৃষকদের কাছে এমন সমস্যার কথা শুনে চমকে উঠেছেন একটি আর্ন্তজাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিশেষজ্ঞরা। শনিবার শিলিগুড়ির দার্জিলিং মোড়ের একটি অভিজাত হোটেলে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির কৃষকদের প্রতিনিধিদের আলোচনায় ডাকা হয়েছিল ‘কনসিউমার ইউনিটি এন্ড ট্রাস্ট সোসাইটি’ সংক্ষেপে কাটে-র তরফে। উদ্দেশ্য, বিপণনে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া, এবং কৃষকদের সমস্যা কেন্দ্র-রাজ্য সরকারকে জানানো। আলোচনায় সিন্ডিকেট অভিযোগ শুনে উদ্বেগে বিশেষজ্ঞরা। সংস্থার নীতি বিশ্লেশক এবং কলকাতা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পৃথ্বীরাজ নাথ বলেন, ‘‘এই প্রথম আমরা প্রান্তিক কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। অনেক রকমের সমস্যার কথা শোনা গেল। সিন্ডিকেটের একটি অভিযোগও রয়েছে। সব সমস্যার কথাই আমরা সরকারকে জানাব। কৃষকদের ব্যপক সচেতন করার প্রয়োজন রয়েছে।’’
ফসল বিক্রিতে কী ভাবে জাল ছড়িয়েছে সিন্ডিকেট?
হলদিবাড়ির একটি কৃষক ক্লাবের প্রতিনিধি জয় সোমের অভিযোগ, যখন টোম্যাটো অথবা লঙ্কা গ্রামের বাজারে ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কৃষকরা বিক্রি করতে বাধ্য হন, সে সময়েই শহরের খুচরো বাজারে ফসলের দাম থাকে নূন্যতম ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি। চড়া দামে ফসল বিক্রির লাভের অঙ্ক কৃষকরা পায় না, গিলে নেয় সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা। জয়বাবুর দাবি, আঙুলদেখা, হেমকুমারীর মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কৃষকদের নিজেদের ফসল ম্যাটাডোরে চাপিয়ে হলদিবাড়ির নিয়ন্ত্রিত বাজারে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। কেননা এতে যেমন খরচ বেশি প্রয়োজন, তেমনই শহরের বাজারে ফসল পাইকাররা না কিনলে সেগুলি ফেরত নিয়ে যেতে হবে, তাতে লাভ তো দূরের কথা, ঘরের থেকেই টাকা দিতে হবে। ফাঁসিদেওয়ার কৃষক প্রতিনিধি কৌশিক হালদার বলেন, ‘‘চিচিঙ্গা, ঢ্যারস গ্রামের বাজারে এক টাকা দু’টাকা দরে বিক্রি হয়। কৃষকদের পক্ষে সেই ফসল শিলিগুড়ির বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা সম্ভব নয়। আবার পর্যাপ্ত হিমঘর না থাকায় সব ফসল রেখে দেওয়াও সম্ভব হয় না। তাই জলের দরে বিক্রি ছাড়া উপায় নেই।’’
কৃষকদের থেকে বাজারের দূরত্ব এবং সঞ্চয়ের উপায় না থাকার সুযোগেই থাবা বসিয়েছে সিন্ডিকেট চক্র। গ্রামের থেকে কৃষকদের থেকে তুলনামূলক অনেক কম দামে ফসল কিনছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। সেই ফসল চড়া দামে শহরের বাজারে বিক্রি করে দ্বিগুণ, তিনগুণ মুনাফা লুটছেন। মূলত এরাই পেশিশক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে অন্য পাইকার ব্যবসায়ীদের গ্রামে ঢুকতে দেয় না বলে অভিযোগ। উল্টোদিকে সিন্ডিকেটের চাপে-হুমকিতে কৃষকরা ফসল নিয়ে শহরের বাজারে গেলে সরাসরি অনেক পাইকার কৃষকদের থেকে ফসল কিনতে চান না।
এ দিনের আলোচনা শুনে বিপণন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেসরকারি বড় সংস্থা সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল কেনার ব্যবস্থা না হলে, সিন্ডিকেট চক্র ভাঙা যাবে না।
পৃথ্বীরাজবাবুর কথায়, ‘‘কৃষকরা যদি একজোট হয়ে নিজেরা ক্লাব তৈরি করে পণ্য শহরের বাজারে পাঠানো শুরু করেন তাতে একটা সুরাহা হতে পারে। খরচ কম হয়। কিন্তু তাতেও বিক্রি যে হবেই এমন নিশ্চয়তা নেই। দেখা যাক সরকারের কাছে আবেদন করব।’’
এ বারের রাজ্যের মন্ত্রিসভায় কৃষি বিপণন দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন হুগলির বিধায়ক তপন দাশগুপ্ত। ইতিমধ্যে সিন্ডিকেট সমস্যার কথা কানেও গিয়েছে তাঁর। এ দিন তপনবাবু জানিয়েছেন, আগামী বুধবার রাজ্যের সব নিয়ন্ত্রিত বাজারের আধিকারিকদের বৈঠকে ডেকেছেন। তপনবাবু বলেন, ‘‘বৈঠকে সিন্ডিকেট অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হবে। গ্রামের প্রান্তিক এবং সর্বস্তরের কৃষকদের রক্ষাকবচ দিতে হবে। সব জেলা থেকে রিপোর্ট নিয়ে পদক্ষেপ হবে।’’
এ দিনের আলোচনায় থাকা কৃষকদের একাংশের দাবি, শুধু কৃষি বিপণম দফতরের পক্ষে সিন্ডিকেট চক্র ভাঙা সম্ভব নয়। পুলিশ-প্রশাসন সকলের সাহায্য ছাড়া ফসল বিক্রি কেনার সিন্ডিকেটের ‘চেনামুখ’গুলো বদলানো যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy