Advertisement
E-Paper

এক ডজন হেলমেট

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের সর্বত্র হেলমেট পরে বাইক চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে। হেলমেট ছাড়া পাম্পে গেলে পেট্রোল মিলবে না— রাজ্যে এই নিয়ম চালু হতে চলেছে। উত্তরবঙ্গের সাত জেলায় এই হেলমেট কাহিনি একনজরে দেখলেন কিশোর সাহা।

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০২:৫৭
ছবি তুলেছেন অমিতকুমার মোহান্ত

ছবি তুলেছেন অমিতকুমার মোহান্ত

হেলমেট পরেননি! তা হলে জরিমানা দিন। ঠিক এ কথাই কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিল সে দেশের পুলিশ। গত জুনের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন একটি এলাকা পরিদর্শনে। মোটরবাইক চালানোর সময় মাথায় হেলমেট ছিল না তাঁর। পুলিশ কিন্তু দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তিকে রেয়াত করেনি। রাজধানী নমপেনে ফিরে গিয়ে সেই জরিমানা জমাও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এবং ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, আইন মেনেই চলা উচিত সকলের। ভারতে এমন নজির বিরলতম। তবে দেশের কয়েকটি জায়গায় আইন চালুর সঙ্গে তা যাতে মান্য করা হয়, সে জন্যও জোর দেওয়া শুরু হয়েছে। পুণেতে এক পুলিশ আর এক পুলিশকে জরিমানা করেছে। মুম্বইয়ে বাইকের দ্বিতীয় আরোহী হেলমেট না পরায় তাঁকে জরিমানার সঙ্গে দু’ঘণ্টা ধরে একটি সেমিনার শুনতে বাধ্য করে পুলিশ। একই ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের সর্বত্র হেলমেট পরে বাইক চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে। হেলমেট ছাড়া পাম্পে গেলে পেট্রোল মিলবে না— রাজ্যে এই নিয়ম চালু হতে চলেছে। উত্তরবঙ্গের সাত জেলায় এই হেলমেট কাহিনি একনজরে দেখলেন কিশোর সাহা।

• নেতার অনুরোধে
দিন কয়েক আগে কদমতলা এলাকায় বিনা হেলমেটের মোটরবাইক আরোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছিল৷ বিনা হেলমেটের অনেককেই জরিমানা করা হচ্ছিল৷ সেই সময় এক কলেজ ছাত্রকে আটকানো হয়৷ কিন্তু, তাঁর কাছে পৌঁছতেই পকেটের ভিতরে মোবাইল ফোনে বেজে উঠল৷ ফোন তুলতেই ওপার থেকে শাসক দলের এক যুব নেতার অনুরোধ, ছাত্রটিকে ছেড়ে দিন প্লিজ। নেতার অনুরোধ ফেলা যায়নি। সুতরাং...।

• ফোন এলেও না
জলপাইগুড়ি শহরেই একটি জায়গায় মোটর সাইকেল চেকিং চলছিল৷ বিনা হেলমেটে বাইক চড়ার জন্য এক যুবককে জরিমানা করা হয়। তখনই পুলিশের
কাছে এক নেতার ফোন। অনুরোধও একই। কারণ ওই আরোহী তাঁর আত্মীয়৷ সে দিন কিন্তু ওই আত্মীয়ের কাছ থেকে জরিমানা নিয়ে তবেই তাঁকে ছেড়েছিলেন ওই অফিসার।

• প্রশ্ন তোলায় বদলি
মামলা দায়ের নয়, শুধুমাত্র বাইক দাঁড় করিয়ে কেন হেলমেট নেই জিজ্ঞেস করেই ফল ভুগেছিলেন ধূপগুড়ির এক পুলিশ অফিসার। সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন। স্থানীয় নেতাদের তখনও চেনেন না। সাদা পাঞ্জাবি পরা এক আরোহীর পথ আটকে এই প্রশ্নটা করেছিলেন সে দিন। পরে ওই অফিসার বলেন, ‘‘একটু তর্কাতর্কিও হয়েছিল। ওই ব্যক্তি নিজের এবং দলের পরিচয় দিয়ে আমাকে শাসতে থাকে। আমি পাল্টা বলেছিলাম, নেতারা কি হেলমেট পরে না?’’ এর ‘ফল’ মিলল হাতে হাতে। এক মাসের মাথায় তাঁকে অন্য মহকুমায় বদলি করা হয়।

• দাদার লোক যাও
কোচবিহার হাসপাতাল মোড়ে চলছে ট্রাফিক পুলিশের পাহারা। কয়েক জন সিভিক ভলান্টিয়ার বাইক থামাচ্ছেন। সেগুলি রাস্তার ধারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক অফিসার বসে কাগজপত্র দেখছেন। হেলমেট বা দুজনের বেশি লোক দেখলেই চলছে জরিমানা। সেখানেই হেলমেট ছাড়াই এক বাইকে দুজন যাচ্ছিলেন। সিভিক দু’জন হাত তুলতেই দাঁড়িয়ে গেলেন ওঁরা। বললেন, “সাহেবকে বলো, আমরা অমুক দাদার লোক।” এক সিভিক একটু তেড়ে বলার চেষ্টা করলেন, “যার লোকই হোন...’’ কথা শেষ হওয়ার আগেই হুমকি। সব দেখেশুনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান ওই অফিসার। চোখে চোখ পড়তেই বলেন, “আরে তোমরা যাও যাও। চিনতে পারেননি ওঁরা।”

• উপহার জোড়া লাউ
কোচবিহারে কিছু দিন আগের ঘটনা। নিশিগঞ্জের বাজারে যাচ্ছিলেন চিলকির হাটের এক যুবক। বাইক আটকাল পুলিশ— হেলমেট কই? গাড়ির কাগজ দেখাও। যুবক বললেন, “স্যার তাড়াহুড়োর মধ্যে হেলমেট আনতে পারিনি।” জরিমানা করা হলে যুবক জানান, জিনিসপত্র বিক্রির পরে টাকা মিলবে। অগত্যা তাঁকে ছেড়ে দেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। তিনি জানান, বিকেলে সেই যুবক ফেরার সময়ে চেক পোস্টে থেমে জরিমানার ১০০ টাকা দিতে চান। ওই অফিসার ভর্ৎসনা করে চলে যেতে বললে নাছোড় যুবকটি দুটি কচি লাউ জোর করে দিয়ে যান অফিসার-কর্মীদের হাতে।

• ফোনে-ফোনে ছাড়
রায়গঞ্জের শিলিগুড়ি মোড়ে কর্মরত এক ট্রাফিক পুলিশের অভিজ্ঞতা। গত ৪ জুলাই বিকেলে তিন যুবক একটি মোটরবাইকে চেপে বেপরোয়া ভাবে সুপারমার্কেট থেকে সুদর্শনপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। চালকের মাথায় হেলমেট নেই। সেই সময় কয়েক জন ট্রাফিক পুলিশ তাদের আটক করে নথি দেখাতে বললে তাঁরা তা দেখাতে পারেননি। হেলমেট পরেননি কেন, এই প্রশ্ন করা হলে মাঝে বসা যুবকটি মোবাইল বের করে ফোন লাগালেন শাসক দলের এক জেলা নেতার নম্বরে। এবং ট্রাফিক পুলিশকে ধরিয়ে দিলেন ফোনটা। ফল? ছেড়ে দেওয়া হল তিন যুবককে।

• টাকা দিল পুলিশই
ভরসন্ধ্যার কদমতলা। জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্বাভাবিক ব্যস্ততা। তীব্র গতিতে এসে একটি বাইক ধাক্কা মারল ট্র্যাফিক পোস্টে। পুলিশ কর্মীরা ছুটে এলেন। বাইক আরোহী দু’জনের কেউই হেলমেট পরে নেই। দায়িত্বে থাকা ট্র্যাফিক পুলিশের অফিসার আরোহীর লাইসেন্স জমা নিয়ে নেন। তার পরে ঘণ্টাখানেকও পেরোয়নি, ফোন এল ওই অফিসারের কাছে। ও প্রান্তে এক তৃণমূল কাউন্সিলর। তাঁর অনুরোধে না বলে দিল পুলিশ। ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি। ফল? একটু পরে ঊর্ধ্বতন অফিসারের ফোন এল ট্র্যাফিক পোস্টে। অভিযুক্ত যুবককে তো লাইসেন্স ফিরিয়ে দিতে হলই। তাঁর নামে যে মামলা হয়েছিল, সেই জরিমানাও দিল পুলিশই! পরে ক্ষুব্ধ এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘নেতার পড়শিকেও ধরা যাবে না! এর পরে তো আর কিছুই বলার নেই।’’

• আসরে কংগ্রেস কাউন্সিলরও
রায়গঞ্জের পুর বাসস্ট্যান্ড মোড় এলাকা। ওই দিন দুই যুবক মোটর বাইকে চেপে বিবিডি মোড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময় একটি রিকশাকে তাঁদের বাইকটি ধাক্কা মারে। কাছেই যে ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী ছিলেন, হেলমেট না পরার জন্য জরিমানা করতে যান বাইক আরোহীকে। কিন্তু খাতা-কলম হাতে নিতেই কংগ্রেস কাউন্সিলরের ফোন। এবং সঙ্গে নির্দেশ— ওই যুবককে ছেড়ে দিন। পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

• হেলমেট কিনে দেব
বেসরকারি সংস্থার কর্মীটি কর্মসূত্রে পুলিশের অনেক বড়কর্তাকে চেনেন। শিলিগুড়ি শহরে স্কুটারে ঘুরে বেড়ান। কোনও দিনই হেলমেট পরেন না। এক দিন সেবক রোডে পুলিশ তাঁকে ধরে। তিনি দু-চার কথার পরেই সোজা উত্তরবঙ্গের এক বড় মাপের পুলিশকর্তাকে ফোন করেন। সেখান থেকে নির্দেশ পেয়ে তাঁকে সে দিন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, পুলিশকর্তা তাঁকে এটাও জানিয়ে দেন, ১০০ টাকা ফাইনের হাত থেকে বাঁচতে বারবার ফোন করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তাই একটা হেলমেট কিনে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এবং বলেন, নিজে কিনে নিতে না পারলে বলুন। আমরাই কিনে দেব! পরে অবশ্য তরুণ পদস্থ কর্মীটি হেলমেট কেনেন।

• ছাড়তে হয়
এক স্কুল পড়ুয়াকে দুরন্ত গতিতে বাইক চালাতে দেখে থামিয়েছিলেন বালুরঘাটের এক পুলিশকর্মী। মাথায় হেলমেট ছিল না। লাইসেন্সও নেই। হবে কী করে! বয়স তো মোটে ১৬ বছর। জরিমানার তোড়জোর শুরু হতেই পকেট থেকে মোবাইল বার করে সরাসরি ফোন এক প্রাক্তন মন্ত্রীকে। পুলিশকর্মী কিছু বলার আগেই তাঁর হাতে ফোন ধরিয়ে ওই প্রাক্তন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে ছাত্রটি। দু-চার বার ফোনে ‘স্যার-স্যার’ বলার পরে ছাত্রটিকে ছেড়ে দেন পুলিশকর্মীটি।

• হেলমেট পরাতে
হেলমেট মাথায় না পরে বাইকে ঝুলিয়ে নেন অনেকেই। তেমনই যাচ্ছিলেন কুমারগ্রামের এক ব্যবসায়ী। আচমকা ঝাঁকুনিতে সেই হেলমেট খুলে পড়ে যায় রাস্তায়। ব্যবসায়ী তা টের পাননি। পিছনেই ছিল পুলিশের গাড়ি। কর্তব্যরত ইন্সপেক্টর তা দেখে গাড়ির গতি বাড়িয়ে ওই ব্যবসায়ীকে সে কথা জানানোর জন্য চালককে নির্দেশ দেন। কিন্তু, পুলিশের গাড়ি ছুটতে দেখে ব্যবসায়ীও গতি বাড়িয়ে দেন। শুরু হয় রূদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা। পুলিশের গাড়িটি একটি বাঁকের মুখে বাইকটিকে ধরে ফেলে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী দাঁড়িয়ে পড়ে ‘ভুল হয়ে গিয়েছে, আর কোনও দিন করব না, হেলমেট পরে চালাব’ বলতে শুরু করেন। অফিসার ধমকে ওঠেন, ‘‘আরে হেলমেট কোথায়! পরবেন কী করে! আগের মোড়ে হেলমেট পরে গিয়েছে দেখেই তো আপনাকে তা বলতে ছুটলাম।’’

• ফাইন লাগবে না, চেঁচিও না
শালুগাড়ার ঘটনা। এক তরুণী স্কুটি চালিয়ে শিলিগুড়ি যাচ্ছিলেন। রাস্তা আটকে হেলমেটবিহীন চালকদের জরিমানা করছিল ট্র্যাফিক পুলিশ। তরুণীটিকে থামাতেই তাঁর চিৎকার, ‘তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন, আমার বাবা নার্সিংহোমে ভর্তি।’ পুলিশ কোন নার্সিং হোম, বাবার নাম, ডাক্তারের নাম জানতে চায়। কথাবার্তার ফাঁকে ডিকি থেকে হেলমেট বার করে মাথায় পরেও ফেলেছেন। ইতিমধ্যে ভিড় জমে গিয়েছে। আচমকা তরুণী চিল চিৎকার জুড়ে দেন, ‘দেখুন হেলমেট পরে আছি। তা-ও জরিমানা করতে চাইছেন ওঁরা’। কৌতূহলী জনতাও পুলিশকর্মীদের গিরে বৃত্ত তৈরি করে ফেলেছেন প্রায়। এক পুলিশ অফিসার গিয়ে তরুণীকে বলেন, ‘‘মা, তুমি যাও। কোনও জরিমানা লাগবে না, শুধু চেঁচিও না।’’ সেই থেকে অভিযানের সময়ে দলের অন্তত এক জন অফিসার মোবাইলের ক্যামেরাও ‘অন রাখেন’।

সহ প্রতিবেদন: অনির্বাণ রায়, অনুপ মোহান্ত, গৌর আচার্য, অভিজিৎ সাহা, নমিতেশ ঘোষ।

আরও হেলমেট কাহিনি, নজর রাখুন আনন্দবাজারে

Helmets North Bengal different scenarios
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy