Advertisement
E-Paper

শিল্পীরা অনটনে, সংক্রান্তির উৎসবে ভাঁটার টান

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় চৈত্র সংক্রান্তির দিন গাজন উৎসব উপলক্ষে চড়ক মেলার মাঠে দেখা যায় পরিচিত দৃশ্য। পিঠে বঁড়শি ফুঁড়ে এক বা একাধিক গাজন সন্ন্যাসী চড়ক গাছে ঝুলে চক্রাকারে ঘুরছে। গায়ে কাঁটা দেওয়া পরিবেশে ভিড়ে ঠাসা সেই মাঠেই কোথাও দুর্গা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অসুর বধ করছেন, কিংবা রাবণ বধ হচ্ছে বা কালী, মহাদেব, ডাকিনি যোগিনী উপস্থিত। ঢাকের বোলের সঙ্গে চলছে গান ‘‘নমঃ শিবায়ঃ সর্বদুঃখহরণকারী/ এসো এসো ভোলেবাবা ত্রিলোচনকারী।’’ শুরু হয় কাঠাম নৃত্য।

অনিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫৪

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় চৈত্র সংক্রান্তির দিন গাজন উৎসব উপলক্ষে চড়ক মেলার মাঠে দেখা যায় পরিচিত দৃশ্য। পিঠে বঁড়শি ফুঁড়ে এক বা একাধিক গাজন সন্ন্যাসী চড়ক গাছে ঝুলে চক্রাকারে ঘুরছে। গায়ে কাঁটা দেওয়া পরিবেশে ভিড়ে ঠাসা সেই মাঠেই কোথাও দুর্গা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অসুর বধ করছেন, কিংবা রাবণ বধ হচ্ছে বা কালী, মহাদেব, ডাকিনি যোগিনী উপস্থিত। ঢাকের বোলের সঙ্গে চলছে গান ‘‘নমঃ শিবায়ঃ সর্বদুঃখহরণকারী/ এসো এসো ভোলেবাবা ত্রিলোচনকারী।’’ শুরু হয় কাঠাম নৃত্য।

চড়ক মেলার মাঠে এ দৃশ্য ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। কাঠাম নৃত্য হল রাজবংশী সমাজের লোকবিশ্বাস বা লোকাচারের আঙ্গিক রূপ। জলপাইগুড়ি, দুই দিনাজপুর ও দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলে, কোচবিহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঠাম নৃত্যের শিল্পীরা। কোথাও গাজনের এক দুই দিন আগে, কোনও এলাকায় পরে অনুষ্ঠিত হয় এই লোকনৃত্য। কাঠাম নৃত্য এখনও কতটা আকর্ষক?

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীপককুমার রায় বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে কাঠাম নৃত্য উপভোগ্য হলেও আঞ্চলিক সংস্কৃতির এই দিকটা হারিয়ে যেতেই বসেছে। যোগদানকারীদের সংখ্যা ক্রমে কমে এসেছে।’’

কোনও কোনও এলাকায় কাঠাম নৃত্যের সঙ্গে গানের প্রচলন রয়েছে। ভক্তিমূলক গানের পাশাপাশি তিস্তার বন্যা, মন্বন্তর এমনকী বেরুবাড়ির ছিটমহল সমস্যার কথাও উঠে আসে গানে। পৌরাণিক চরিত্রের পাশাপাশি দেখা যায় লাদেন ও তার সঙ্গীদের কাঠাম। গ্রামে প্রেম বা বিবাহকে কেন্দ্র করে সাজা হয় যুগলের কাঠামও। ময়নাগুড়ি ব্লকের দারিকামারি গ্রামে কাঠাম নৃত্যের নির্দেশক কেটু অধিকারী জানান, দল ধরে রাখাটা এখন অনেক কঠিন ব্যাপার। এর জন্য অনুশীলন বা চর্চার দরকার। এর থেকে কোনও অর্থসংস্থান হয় না।

কাঠাম অর্থে এক ধরনের দেবতার আদল। যে আদলকে সামনে রেখে বিভিন্ন নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা হয়। মূলত গাজনের দিন কাঠাম নৃত্য অনুষ্ঠিত হলেও, বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে কাঠাম নৃত্যের চল রয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন দেবতার রূপে সাজেন। কালী, মহাদেব, ডাকিনী যোগিনী এ হল কালী কাঠাম। দুর্গা কাঠামে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অসুর বধ করা হয়। মেক আপের রঙ এবং পোশাক আশাক মিলিয়ে এই নৃত্য বেশ ব্যয়বহুল। অভাব অনটন যাদের নিত্যসঙ্গী সেই অনিল অধিকারী, গোরাচাঁদ রায়, উৎপল অধিকারী, প্রভাস রায়দের মতো শিল্পীদের পক্ষে এই লোকনৃত্যকে বাঁচিয়ে রাখা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

শুধু কি কাঠাম নৃত্য? বিলুপ্তির পথে চৈত্র মাসে মদনকামের পুজোকে কেন্দ্র করে বাঁশখেলার নৃত্যগীতিগুলিও। ছেলের দল গান ধরে, ‘‘চৈত মাসে চৈত্র খেলা / ভর পূর্ণিমার চান।/ হাতে ধনুক, কোঁচায় বাটুল, নামিল মদনকাম।’’ কয়েকটি বাঁশ সাদা কাপড়ে মুড়ে, বাঁশের মাথায় লাগানো হয় চামর, পানসুপারি।

এরকম কয়েকটি বাঁশ ঘাড়ে নিয়ে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন পাড়া বা গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ঘোরে। গানের সঙ্গে ঢাক বাজাতে বাজাতে সংগ্রহ করে চাল বা টাকা পয়সা। চৈত্র মাসের ত্রয়োদশী ও চতুর্দশীতে মদনকামের পুজো ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মদনকামের প্রতীক হিসেবে বাঁশকে পুজো করা হয়।

পুজো শেষে ছেলে ছোকরার দল মাঙন তুলতে বের হয়। দলে থাকে মূল গায়ক বা গীদাল, থাকে দোয়ারী বা কৌতুকাভিনেতা আর থাকে ছোকরা (মহিলাবেশী পুরুষ)। গানের সঙ্গে থাকে নাচ।

দীপকবাবু বলেন, ‘‘গ্রামে চাহিদা থাকলেও পেশাগতকারণে যোগদানকারীদের সংখ্যা কমে এসেছে। যারা একসময়ে কৃষিজীবী ছিলেন, তাঁরা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।’’

এই পুজোর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি সম্পর্কিত বিষয়। ভাল ফসলের আশায় এই পুজো করা হয়। গ্রামেগঞ্জে যে সব দলগুলি মদনকামের পুজো বা বাঁশ খেলা করে থাকে সেই দলগুলির নাম হয় গানের রীতি অনুযায়ী। যেমন বড়জাগ বা ছোটজাগের গানের দল। এর গানের বিষয় হয়ে থাকে রাধা-কৃষ্ণের কথা, ঢোল বাজিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে ঢুলিয়া দল। আবার কোনও এলাকায় মদনকামের দল গায় গাথাধর্মী ‘মালাগিরিবরের’ গান। খ্যামটা নাচের মতো ‘ধামালী’ পরিবেশন করে পেষ্টাবান্ধার দল।

কোচবিহার ২ নম্বর ব্লকের চন্দনচূড়া গ্রামের ক্যানবাজের দলের নিতাই রায়, উত্তম রায়, অধীর রায়, নন্দেশ্বর রায়ের অভিজ্ঞতা হল, ‘‘আমরা দিনমজুরি করি। মাঙন তুলতে দশ বারো দিন বাইরে ঘুরতে হয়। সেই সময় সংসার চালালে কঠিন হয়ে পড়ে।’’

জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে যা মদনকামের পুজো বা বাঁশখেলা নামে পরিচিত, দার্জিলিং বা দিনাজপুরে তার নাম রাখা হয়েছে বুড়া ঝেল্লার পুজো। মদনকামের গীতের সঙ্গে পরিবেশিত নৃত্যের রয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিক। কোনটির নাম ‘ঘুরানি’ তো কোনটি ‘আড়াইপ্যাঁচ’ এর নৃত্য, রয়েছে ‘ঢুলানি’। গৌড় মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা ও লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা সোম বলেন, ‘‘এই লোকাচার ও লোকনৃত্যগুলি সেই জনজাতির চিহ্ন বহন করে। এগুলি হারিয়ে যেতে থাকলে অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দেবে।’’

ইতিমধ্যেই মিলিয়ে গিয়েছে ‘ঘোড়া খেলা’ বা ‘শিরুয়া বিষুয়া’ পুজোকে কেন্দ্র করে গাওয়া লোকগীতি বা নৃত্যগুলি। রাজবংশী সমাজের জোতদাররা এক সময় বছর শেষের এই দিনটিতে ঘোড়ায় চড়ে প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে খোঁজখবর নিতে যেতেন। তারই অঙ্গ এই ঘোড়া খেলা। তরাই অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন অথবা বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখে এটি দেখা যায় বলে জানান দীপকবাবু। পাড়া বা গ্রামের বাড়িতে ঘোড়া সেজে নাচ দেখায় শিল্পীরা। সঙ্গে বাজতে থাকে ঢাক। সবাই গেয়ে ওঠেন, ‘‘শরৎলাল নামে লোকটারে ভাই/ খোপালঅআসিত (জায়গার নাম) ঘর/ তাহার বেটি সুরজমনি দেখিতে সুন্দর।’’ গানের মধ্যে ধরা পড়ে গ্রামের একটি মেয়ের ভাব ভালবাসার কথা। দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি ব্লকের দোহাগুড়ি গ্রামের ঘোড়াখেলার শিল্পী তারণ সিংহ বলেন, ‘‘গ্রামের কোথাও কোনও ঘটনা ঘটলে সেই খবর ঘোড়া খেলার মধ্যে দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আমি নিজে অংশগ্রহণ করতাম। এখন ঘোড়া খেলার আকর্ষণ হারিয়ে গেছে।’’

মালদহে পরিচিত ‘সাকারাৎ’ নামে, জলপাইগুড়িতে বিষুমা, আবার তরাই অঞ্চলে এরই নাম শিরুয়াবিষুয়া উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এক ধরনের নাচ গানের চল রয়েছে। শিরুয়া শব্দের অর্থ সংক্রান্তি। বিষুয়া শব্দটি এসেছে বিষুব থেকে। যে সংক্রান্তিতে বিষুব রেখার উপরে সূর্যকিরণ সরাসরি পড়ে সেটা চৈত্র সংক্রান্তি।

ভক্তরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নাচ গান করে থাকে। বিরহের সুরে পরিবেশিত হয় গান। আর নাচের যে বিশেষ আঙ্গিক রয়েছে তার নাম বিশ্শাল। এখানে নাচ হয় লাফিয়ে লাফিয়ে। কোনটির নাম ‘ব্যাঙ বিশ্শাল’ তো কোনওটি ‘ঘোড়া বিশ্শাল।’ তরাই অঞ্চলের গানগুলি আবার প্রেমপ্রীতি সম্পর্কিত। নকশালবাড়ি ব্লকের শিরুয়াবিষুয়া নৃত্যগীতের দলের দলের নিশিকান্ত সিংহ, গেয়ান সিংহ, করেন অধিকারী, পবন সিংহরা জানান, ‘‘গ্রামের লোকেরা এখন টিভি, সিনেমা দেখতেই বেশি আগ্রহী। এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। আমরাও উৎসাহ পাই না।’’

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ও সংগ্রাহক দীপেশ রায় বলেন, ‘‘দিন পাল্টেছে, মানসিকতাও বদলেছে। এই লোকসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রচার, প্রসার ও সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দরকার। তবেই শিল্পীরা চর্চার আগ্রহ বোধ করবে।’’

sankranti festival artists suffering chaitra sankranti charak gajon north bengal festivals
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy