Advertisement
০৭ মে ২০২৪

সর্পোদ্যান হয়নি, রুজির টানে জীবন বাজি

একের পর এক ঝাঁপি খুলতেই ফণা তুলে বেরিয়ে পড়ছে বিষধর সাপ। বীণের শব্দে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ক্রমাগত ফোঁসফাঁস করে চলেছে কেউটে, গোখরোরা। গলা ফুলিয়ে বীণ বাজিয়ে তালে তালে চলছে নাচ। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশ ভিড়ে থিকথিক। সবশেষে ঝাঁপিতে পয়সা ছুড়ে দিলেন দর্শকেরা।

চাঁচলে সাপ খেলা দেখাচ্ছে জহিরুদ্দিন। বাপি মজুমদারের তোলা ছবি।

চাঁচলে সাপ খেলা দেখাচ্ছে জহিরুদ্দিন। বাপি মজুমদারের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
চাঁচল শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

একের পর এক ঝাঁপি খুলতেই ফণা তুলে বেরিয়ে পড়ছে বিষধর সাপ। বীণের শব্দে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ক্রমাগত ফোঁসফাঁস করে চলেছে কেউটে, গোখরোরা। গলা ফুলিয়ে বীণ বাজিয়ে তালে তালে চলছে নাচ। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশ ভিড়ে থিকথিক। সবশেষে ঝাঁপিতে পয়সা ছুড়ে দিলেন দর্শকেরা।

কৌটোয় পয়সা ভরে ফের নতুন গন্তব্যে পা বাড়ানো সাপুড়ের বয়স মেরেকেটে ১৩। নাম জহিরুদ্দিন বেদে। সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি গর্ত খুঁড়ে বিষধর সাপ ধরতেও পিছপা হয়না ওই কিশোর। জহিরুদ্দিন একা নয়। মালদহের চাঁচল-২ ব্লকের কান্ডারন বেদেপাড়ার শিশুকিশোরদের শৈশব এ ভাবেই দারিদ্রের জাঁতাকলে হারিয়ে গিয়েছে। বন্যপ্রাণ আইনে সাপ খেলা বেআইনি। কিন্তু পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের মতো চাঁচলের বিভিন্ন এলাকায় শিশুকিশোররাও সাপ খেলা দেখাচ্ছে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। দিনকয়েক আগে কলিগ্রাম এলাকায় সাপ খেলা দেখাচ্ছিল জহিরুদ্দিন। বাসিন্দারাই জানালেন, কয়েকমাস আগে এক বাড়িতে সাপ ধরতে দিয়ে বিষধর সাপে কামড়ানোর পর বাসিন্দারাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করান। কোনওক্রমে সে যাত্রা বেঁচে গেলেও সাপ খেলা দেখানো বন্ধ হয়নি তার।

সমস্যার কথা অজানা নয় বন দফতরেরও। মালদহের ডিএফও মীনাক্ষী প্রসাদ বলেন, ‘‘বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নেই বলেই ওদের অনেকেই সাপ নিয়ে খেলা দেখায়। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক সভায় একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছি। বিডিওদেরও বলেছি। ওদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির বিষয়টি তো প্রশাসনকেই দেখতে হবে। খিদে সবার আছে। যাতে আইন বাঁচে, সাপও বাঁচে আর ওদের জীবনটাও বাঁচে তা দেখতে হবে। আইন দিয়ে সব সময় সব সমস্যার সমাধান হয় না। বিষয়টি নিয়ে ফের ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।’’

সাপের ছোবলে অনেকের মৃত্যুর পরও কেন বেআইনি বিপজ্জনক ওই পেশা আঁকড়ে ধরে রয়েছেন ওঁরা? সামসি কলেজের অদূরে কান্ডারন এলাকায় শতাধিক বেদে পরিবারের বাস। প্রত্যেকেই ভূমিহীন, দুঃস্থ। খাস জমিতেই বসবাস। বাম আমলে বেদেপাড়ার হাল ফেরানো-সহ শিশুকিশোরদের পাঠশালায় পাঠাতে তাঁদের বিকল্প জীবিকার কথা ভাবা হয়েছিল। আর তাই সেন্ট্রাল জু অথরিটির অনুমোদিত রাজ্যের একমাত্র সর্পোদ্যানটি গড়ে তোলা হয়েছিল সেখানে। ওই সর্পোদ্যানকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল বেদেপাড়া। বলা হয়েছিল, সর্পোদ্যানে সাপ সংরক্ষন করা হবে। টিকিট বিক্রির সঙ্গেই সাপের বিষ বিক্রি করেও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা হবে। সর্পোদ্যান নিয়ে সবথেকে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রবীন আলি মহম্মদ বেদে। তিনি বলেন, ‘‘সর্পোদ্যানের দুটি চৌবাচ্চা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর তাই ফের অনেকেই ফিরে এসেছেন পুরনো পেশায়। তা না হলে যে সন্ধেবেলায় হাঁড়ি চড়ে না।’’

প্রশাসন জানায়, বাসিন্দাদের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড না থাকায় তাদের সাহায্য করা যাচ্ছিল না। সেই উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বেশ কিছু বাসিন্দাকে সরকারি প্রকল্পে বাড়িও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। চাঁচল-২ ব্লকের বিডিও ঈশে তামাং বলেন, শিশুকিশোররা যাতে স্কুলে যায় সে জন্য কাছাকাছি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। ওঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যাতে উন্নতি হয় সেই চেষ্টা চলছে। সর্পোদ্যান যাতে গড়ে ওঠে সেই চেষ্টাও করা হচ্ছে। মালদহ জেলা সর্পোদ্যান সংরক্ষণ সমবায় সমিতির সম্পাদক করিম বেদে বলেন, ‘‘আমরা কখনও সাপ মারিনা। খেলা দেখানোর জন্য সাপ ধরি। সর্পোদ্যান তৈরি হলে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা হত। তাহলে আইনও বাঁচত, আমরাও বাঁচতাম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chanchal snake Malda BDO minakshi prasad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE