Advertisement
২১ মে ২০২৪

চা বাগানের আবাসন যেন ভূতের বাড়ি

এক ঝলক দেখলে ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হতে বাধ্য। ঘরের দেওয়াল ও পিলারের বেশিরভাগ জায়গা থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে আস্ত ইট বেরিয়ে এসেছে।

এমন জরাজীর্ণ ঘরেই দিন কাটাতে হয় রায়পুর বাগানের শ্রমিকদের। ছবি: সন্দীপ পাল

এমন জরাজীর্ণ ঘরেই দিন কাটাতে হয় রায়পুর বাগানের শ্রমিকদের। ছবি: সন্দীপ পাল

পার্থ চক্রবর্তী
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০১:৫১
Share: Save:

এক ঝলক দেখলে ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হতে বাধ্য। ঘরের দেওয়াল ও পিলারের বেশিরভাগ জায়গা থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে আস্ত ইট বেরিয়ে এসেছে।

কোথাও একাধিক ইট খসে পড়ে ঘরের দেওয়ালটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ঘরের দরজা জানলার পাল্লা ভেঙে গিয়েছে। খুলে গিয়েছে কাঠামোও। ঘরে টিন বা অ্যাসবেস্টসের চাল থাকলেও অধিকাংশ জায়গাতেই তা ভেঙে গিয়েছে। ভাঙা জায়গা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকলেও তা আটকাতে পারছে না ভরা বর্ষার বৃষ্টিকে। জলে ভরে যাচ্ছে ঘর।

জলপাইগুড়়ির রায়পুর চা বাগানের শ্রমিক আবাসের অবস্থা এখন এরকমই। বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাওয়া ওই ঘরগুলিতে কোনওমনে দিন কাটাচ্ছেন চা বাগানের কয়েক হাজার বাসিন্দা।

বছরের পর বছর ধরে সংস্কার হয়নি এই শ্রমিক আবাসগুলির। শুধু এখানেই শেষ নয়। শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম পরিস্রুত পানীয়জলের ব্যবস্থাও নেই বাগানে। বাগানে একটি হাসপাতাল রয়েছে ঠিকই, কিন্তু সপ্তাহে মাত্র দু’দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য সেখানে একজন চিকিৎসকের দেখা মেলে৷ সপ্তাহের বাকিদিনগুলিতে হাসপাতালের দায়িত্ব সামলান শুধুমাত্র একজন নার্স৷

১৯২৪ সালে রায়পুর চা বাগানটি গ়ড়ে ওঠে। ১৯২৯সালে চালু হয় বাগানের ফ্যাক্টরি। আর্থিক লোকসানের জন্য ২০০৩ সালে অক্টোবর মাসে প্রথমবারের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বাগানটি। এরপরে ২০০৫ সালে ফের খুললেও মাস তিনেকের মধ্যেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাগান খোলা বা বন্ধ হওয়ার পর্যায় এখানেই থেমে থাকেনি। ২০০৯সালে ফের বাগান খোলে ৷ তারপর আবারও ২০১৩ সালের মাঝামাঝি বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর ২০১৪ সালের জুলাই মাসে তামিলনাড়ুতে চা-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত একজন বাগান পরিচালনার ভার নেন। ততদিনে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে শ্রমিকদের অবস্থা।

বাগানের কর্মীরা জানাচ্ছেন, বাগানের অনেক পুরানো গাছ মরে গেলেও সেগুলিতে নতুন চা-গাছ লাগানো এখনো সম্ভব হয়নি ৷ বাগানের ফ্যাক্টরিতে গ্রীন টি তৈরি হলেও তা নিয়মিত চালু রাখা যাচ্ছে না৷ বাধ্য হয়ে চায়ের কাঁচা পাতাও বিক্রি করতে হচ্ছে৷

কোনওমতে চলা এই বাগানে সবচেয়ে বেশি দুর্দশায় শ্রমিকরা৷ বাগানের শ্রমিক কানু মুন্ডার কথায়, “বাগানের কোয়ার্টারে বাস করি ঠিকই৷ প্রায় প্রতিদিন রাতেই মাথার ওপর দিয়ে ঘরের ভেতরে জল পড়ছে৷ এখানে থাকাটা সমস্যা হলেও কোনও উপায়ও নেই ৷” বাগানের আরেক শ্রমিক জয়রাম ওঁরাও বলেন, “স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আমিও এখানে পড়ে রয়েছি ৷ কিন্তু কীভাবে দিন কাটাচ্ছি সেটা কেবল আমিই জানি ৷”

বাগান কর্তৃপক্ষ কোয়ার্টারের সংস্কার না করায় রায়পুর চা-বাগানের শ্রমিকদের কেউ কেউ বাঁচার তাগিদে তাঁদের নিজেদের কোয়ার্টারের জমিতেই বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়েছেন৷ কিন্তু সেটাও সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি ৷ এমনই একজন দূর্গা সিং ৷ তিনি বলেন, “বাড়ির জিনিসগুলিকে বাঁচাতে সেগুলিকে কোয়ার্টারের ঘরের এক কোণে রেখে দিয়েছি৷ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রাতের বেলায় আমি চলে যাচ্ছি বাড়ির কাছের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায়৷ সেখানেই প্রতি রাত কাটছে৷”

তবে বাগান কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা মানছেন। রায়পুর চা-বাগানের ম্যানেজার চরণপৃথ কুন্দন বলেন, “শ্রমিকদের থাকার সমস্যা রয়েছে। সেটা আমরাও জানি৷ কিন্তু রায়পুর চা-বাগান এখন বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে৷’’ শ্রমিকদের থাকার জায়গাটাকে ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা তাঁরা করছেন বলে জানান বাগান কর্তৃপক্ষ।

সরকারের একটি প্রতিনিধি দলও সম্প্রতি শ্রমিক আবাসের অবস্থা দেখে গিয়েছেন বলে জানান বাগান কর্তৃপক্ষ৷ পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য পরিস্রুত পানীয়জল এবং হাসপাতালকে ভাল অবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা করা হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বাগানের কর্তৃপক্ষের তরফে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jalpaiguri Tea estate Ghost house
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE