আজগরকে আলিঙ্গন। —নিজস্ব চিত্র।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে বাবার হাত ধরে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে মধ্য মশালডাঙায় এসেছিলেন। সেখানেই পরে বাড়িঘর করেন। সংসার হয়। তারপরে দীর্ঘ কয়েক দশকের নাগরিকত্বহীনতার যন্ত্রণা। এ বার বিধানসভা ভোটের আগে সেই আক্ষেপ ঘুচেছে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রথমবার ছেলে ও নাতিকে সঙ্গে নিয়ে ভোটও দিয়েছেন। এ বার ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রথম ইদেও তিন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে নামাজ পড়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য অবশ্য সেই ইচ্ছে পূরণ হল না তাঁর।
‘তিনি’ আজগর আলি। বয়স একশো পেরিয়েছে কয়েক বছর আগেই। কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার আওতাধীন সাবেক ছিটমহল মধ্য মশালডাঙার বাসিন্দা আজগর আলিকে সঙ্গে নিয়ে তাই ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পর এক সঙ্গে নামাজ পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর পরিজন থেকে প্রতিবেশীদের অনেকেরও। তা না হওয়ায় মন খারাপ অনেকেরই। আজগর নিজেও খানিকটা বিষণ্ণ। বয়সের ভারে নতজানু হয়ে পড়া আজগর আলি কোনও রকমে অস্ফুটে বললেন, “এবারের ইদ আমাদের কাছে অন্যরকম অনুভূতির ব্যাপার ছিল। ইচ্ছে থাকলেও শরীর খারাপ বলে সবাইকে নিয়ে এক সাথে নামাজ পড়া সম্ভব হয়নি।”
আক্ষেপের ছাপ স্পষ্ট তার ছেলে বেলাল হোসেন, নাতি জয়নাল আবেদিনের কথাতেও। বেলালবাবু বলেন, “এ বার বিধানসভা ভোটের কিছু দিন আগে সচিত্র পরিচয়পত্র পেয়েছিলাম। ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে একসাথে সবাই ভোট দিয়েছি। কিন্তু এ দিন বাবাকে মধ্য মশালডাঙা ময়দানে ইদের নামাজ পড়তে নিয়ে যাওয়া যায়নি। কিছুটা খারাপ তো লাগছেই।” জয়নাল জানিয়েছেন, তাঁর দাদুর বয়স ১০৩ বছরের বেশি। বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় কাবু হয়ে পড়েছেন। তাই অন্য বারের মতো এ বার নামাজ পড়তে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘অথচ ভোটের দিনও বলেছিলেন বাবা ও আমার সঙ্গে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার মতো ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রথম ইদের নামাজে সঙ্গী হবেন। তাই খুশির দিনেও খুবই খারাপ লাগছে।’’
গত বছর ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় হয়। মধ্য মশালডাঙা, পোয়াতেরকুঠি, করলা, বাত্রিগছ, শিবপ্রসাদমুস্তাফি, কচুয়ার মতো ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের এলাকাধীন হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের আওতাভুক্ত হয়েছে এদেশের ১১১টি ছিটমহল। দুই দেশের বাসিন্দারা নিজেদের পচ্ছন্দ মতো নাগরিকত্বও পেয়েছেন। শতায়ু আজগর আলি ওই বাসিন্দাদের মধ্যে প্রবীণতম। তাই তাঁকে নিয়ে মধ্য মশালডাঙা শুধু নয় গোটা সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যেই আলোচনা রয়েছে।
এ দিন প্রতিবেশী ও পরিচিতদের অনেকে বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে ইদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাদের একজন তালেব আলি বলেন, “নাগরিকত্বহীনতার যন্ত্রণা ঘোচানর স্বপ্ন দেখতে উনি বরাবর আমাদের সাহস যুগিয়েছেন। তাই ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রথম ইদের নামাজ ওঁর সঙ্গে পড়ার ইচ্ছে ছিল। তা হয়নি বলে খারাপ লাগছে। তাই বাড়িতে গিয়েই আলিঙ্গন করেছি।” নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “সাবেক ছিটমহলই শুধু নয়, রাজ্যের মধ্যেই প্রবীণতম ভোটার আজগর আলি। উনি ময়দানে অন্যদের সঙ্গে নামাজ পড়তে পারলে খুশি হতাম। ব্যাক্তিগতভাবে ওঁর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার ব্যাপারে আমি ওয়াকিবহাল। কয়েকদিন আগে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনও বলেছিলেন ভারতীয় নাগরিকত্বপ্রাপ্তির পর সবার সঙ্গে যেমন ভোটদান করতে গিয়েছিলেন, তেমনই প্রথম নামাজটাও সবার সঙ্গে পড়তে চান।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy